মৌসুমী বায়ু বিলম্বে খড়ায় পুড়ছে দেশ
প্রকাশিত : ৭ জুন ২০২৩
ঈশিতা জাহান: ঋতুর পরিক্রমায় জুন মাসের মাঝামাঝিতে বাংলায় বর্ষা ঋতু শুরু হয়। ভারত মহাসাগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী এই সময় প্রচুর জলীয় বাষ্প নিয়ে স্থলভাগে এসে ব্যাপক বৃষ্টি ঝরায়। তাতে অবসান ঘটে গ্রীষ্মকালের। আষাঢ় মাস জুনের মাঝামাঝিতে শুরু হলেও দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু অধিকাংশ সময় জুন মাসের শুরুতেই স্থলভাগে এসে পড়ে, ফলে ধীরে ধীরে বৃষ্টির প্রবণতা বাড়ে। তবে এবার সাগরে দুটি লঘুচাপের কারণে মৌসুমী বায়ু আসতে দেরি হচ্ছে। যে কারণে দেশজুড়ে বৈরি আবহাওয়া বিরাজ করছে। দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদু, মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ আগামী চার থেকে পাঁচ দিন অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে ভ্যাপসা গরম বাড়তে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন।
আজ সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে, রাজশাহী ও পাবনা জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও বান্দরবান জেলাসহ ঢাকা, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং রাজশাহী বিভাগের অবশিষ্টাংশের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। সেটা অব্যাহত থাকতে পারে। গতকাল ঢাকায় ঘণ্টায় আট থেকে ১২ কিলোমিটার বেগে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল সকাল ৬টায় বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ছিল ৮৭ শতাংশ।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার ওপর দিয়ে দক্ষিণ অথবা দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। একইসঙ্গে বৃষ্টি অথবা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। এ অবস্থায় এসব এলাকার নদীবন্দরগুলোকে এক নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, তাপপ্রবাহের মধ্যে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়লে ভ্যাপসা গরম আরো বাড়বে। তাপপ্রবাহের ফলে গরমে শরীরে যে ঘাম হয়, জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে সেই ঘাম বাতাস শুষে নিতে পারে না। ফলে শরীরে তাপ না কমায় বাড়ে গরম অনুভূতি।
আবহাওয়াবিদরা আগেই জানিয়েছেন, চলতি বছর গরমে অস্বস্তি বাড়তে পারে। কারণ, শুরু থেকে দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমি বায়ু কম হওয়ার কারণে তাপপ্রবাহের মাত্রা ও বিস্তার বেশি ছিল। গত এপ্রিলেও তাপমাত্রা উঠেছিল রেকর্ড পরিমাণ। গত ১৭ এপ্রিল আগের নয় বছরের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ঈশ্বরদীতে, ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ২০১৪ সালের মে মাসে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩ দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ১৬ এপ্রিল আগের ৫৮ বছরের মধ্যে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় ১৯৬৫ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এর আগে ১৯৬০ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে ৪২ দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ১৯৭৫ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৫ দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস।গত মাসে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে বৃষ্টিপাতের দেখা মিললেও ফের তাপপ্রবাহের মধ্য দিয়েই যেতে হচ্ছে দেশবাসীকে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান জানিয়েছেন, জুনেও স্বস্তি মিলবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবহাওয়া বিজ্ঞানী ড. তৌহিদা রশিদ বলেন, এবারে তাপপ্রবাহ লম্বা সময় ধরে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। এমন কিন্তু প্রতি বছর হয় না। বিরতি দিয়ে দিয়ে হত। তিনি আরো বলেন, গত ১০ মাসে সারা পৃথিবীর তাপমাত্রা দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। চলতি বছর এক দশমিক ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। কাজেই এবারের তাপপ্রবাহের পেছনে যে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের (বৈশ্বিক উষ্ণায়ন) প্রভাব রয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমার উপকূলে ৭ জুন একটা লঘুচাপ তৈরি হতে পারে এবং আরব সাগরে একটি সুস্পষ্ট লঘুচাপ এখনো আছে। দুই সাগরে দুই লঘুচাপ বিদ্যমান থাকার কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের উপর মৌসুমী বায়ু প্রবাহ আরম্ভ হতে কিছুটা দেরি হতে পারে।
তিনি আরো বলেন, গত কয়েকবছর ধরেই জুনের প্রথম সপ্তাহে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তাপমাত্রা কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ করছে। সাধারণত আমাদের দেশের চট্টগ্রাম বিভাগে মৌসুমী বায়ু প্রবাহ জুনের প্রথম সপ্তাহে শুরু হয় এবং সারাদেশে তা বিস্তার লাভ করতে করতে ১৪ জুন পর্যন্ত লাগে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে ২০১৫ সালের পর থেকে দেখা যাচ্ছে যে মৌসুমী বায়ু আরম্ভ হতে এবং বাংলাদেশের ওপর বিস্তার লাভ করতে সময় লাগছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, গত বছর লাগলো ২৩ জুন, তার আগের বছর ১৭ জুন, তারো আগে বোধহয় ১৩ বা ১৪ জুন। সুতরাং, মৌসুমী বায়ুপ্রবাহটা একটু অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। আর, বর্ষাকালের আরম্ভ এবং বিদায়, দুই ক্ষেত্রেই সিজনাল শিপমেন্ট-এর কারণে কিছুটা ব্যত্যয় পরিলক্ষি। এবছরও মৌসুমী বায়ুর স্বস্তি পেতে জুনের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে ড. মল্লিক মনে করেন।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, এ বছর আন্দামান দ্বীপে সময়ের আগে মৌসুমী বায়ু চলে এলেও ভারত উপকূলে তা আসতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দেরি হবে। তারা বলছে, স্বাভাবিক সময়ে ৫ জুনের মধ্যে মৌসুমী বায়ুর বাংলাদেশ উপকূলে পৌঁছার কথা থাকলেও এখনও অনেক দূরে রয়েছে। তবে শ্রীলঙ্কা এরই মধ্যে মৌসুমী বায়ুর দেখা পেয়েছে।
আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক জানান, চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে গরম অসহনীয় হওয়ার মূল কারণ হল বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ছোঁয়া বাংলাদেশেও লেগেছে। তাছাড়া, এল নিনো সক্রিয় অবস্থায় যাওয়া শুরু করায় এখানে আকাশ প্রায় মেঘমুক্ত। সুতরাং, আট থেকে ১২ ঘণ্টা ধরে প্রখর সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠে পতিত হতে থাকে। একারণেই বাতাসের গতিবেগ কম, বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য বেশি। অস্বস্তিও বেশি। তবে এটা শুধু বাংলাদেশেই হচ্ছে, তা না। বাংলাদেশসহ আশেপাশের সকল অঞ্চলের তাপমাত্রাই এখন বেশি।
এল নিনো জলবায়ুর একটি বিশেষ অবস্থা; যা প্রশান্ত মহাসাগরের বিষুবীয় অঞ্চলের পানির উপরিভাগকে উত্তপ্ত করে তোলে, যার প্রভাব পড়ে অয়ন বায়ু ও পারিপার্শিক জলবায়ুর উপর।
আবহাওয়াবিদ মল্লিক বলেন, এল নিনো সক্রিয় হওয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশসহ ভারতের হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, আফগানিস্তান; এই পুরো অঞ্চল এখন ‘হিট ইঞ্জিন’ হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশে এখন মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হওয়ার সময়। কিন্তু এখনো তা না আসাকে চলমান তাপপ্রবাহের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখান তিনি।