ইতালিতে যে পাপের কারণে ধ্বংস হয়েছিল পম্পেই নগরী
প্রকাশিত : ১০ নভেম্বর ২০২২
ইতালীর একটি ছোট্ট শহর ছিল পম্পেই। নেপলস এর পাশেই এর অবস্থান। সব থেকে বড় পরিচয় হল বিশ্বের ভয়ংকরতম সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াস পর্বতের পাদদেশেই ছিল এই শহরটি। ২০ হাজার লোকের বসবাস ছিল এই শহরে। খ্রীষ্টপূর্ব ৮৩ সালে ভয়াবহ এক ভুমিকম্পে শহরটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তার পর থেকেই শহরটি পুনর্গঠিত হচ্ছিল। যদিও তৎকালীন রোমান সাম্রাজ্যের অস্থিরতাও প্রকট ভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছিল এই শহরে। অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, অশ্লীলতায় ভরে গিয়েছিল নগরীর পরিবেশ।
সম্ভবত ভিসুভিয়াসও সহ্য করতে পারছিল না এমন অবস্থা। অবশেষে ৭৯ খীষ্টপূর্বাব্দের ২৭শে আগস্ট সে জ্বলে উঠল প্রলয়ঙ্কর ভাবে। নিমেসেই আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে পুরে ছাই হয়ে গেল পম্পেই নগরী। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সভ্যতা, প্রাণিকূল, নগর, বন্দর ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক পম্পেই নগরীর ধ্বংস হওয়ার কাহিনি যেন সবার থেকে আলাদা, সবচেয়ে অনন্য। তাই তো আজ পম্পেই নগরী পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তবে তার পেছনের ইতিহাসটা কিন্তু করুণ। সেই করুণ ইতিহাসই আজ স্মরণ করা যাক। চোখের পলকে একটা শহর আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে ডুবে ধ্বংস হয়ে গেছে কল্পনা করতে পারেন? চোখের পলক ফেলার ও সময় পায়নি মানুষ, তার আগেই পরিণত হয়েছে জীবন্ত মমিতে, জীবন্ত মূর্তিতে।
বর্তমান সময়ের মতোই বহুকাল আগেও ইতালি সমগ্র বিশ্বের মধ্যে অন্যতম শিল্প সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হতো। আর সেই শিল্প সংস্কৃতির কেন্দ্রই ছিল ইতালির পম্পেই নগরী। ভূমধ্যসাগরের উপত্যকায় ভিসুভিয়াস পাহাড়ের পাদদেশে নেপলস শহরের পাশেই গড়ে উঠেছিল শহরটি। পম্পেই এর একপাশে ছিল হারকুলেনিয়ান শহর ও অন্যপাশে স্ট্যাবি শহর। তৎকালীন ইতালির রাজা ওসকান খ্রীস্টপূর্ব ৭ থেকে ৬ শতাব্দীর দিকে এই শহরের গোড়াপত্তন করেন। এই শহরটি পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠে খ্রীস্টপূর্ব ৪ শতাব্দীর দিকে। আর তখন ইউরোপে সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধের মাধ্যমে পম্পেই নগরী রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। তখন থেকেই রোমানরা সেখানে বসবাস শুরু করে।
ক্রমান্বয়ে সেটি হয়ে ওঠে সমকালীন বিশ্বের অন্যতম বিত্ত-বৈভব আর অভিজাত নগরী। কি ছিলো না সেই শহরে! প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো এই নগর হয়ে ওঠে রোমান ও গ্রিকদের বাণিজ্যনগরী। কিন্তু এই নগর তার তৈরির সময় থেকেই সৌন্দর্যের কারণে ও চলমান শিল্প সংস্কৃতির আড্ডাখানার কারণে বাণিজ্যনগরীর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক নগরী হিসেবেও পরিচিত হয়ে ওঠে। সে সময় প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি ছিল নগরটি। এটি ছিল দুই হাজার বছরের পুরনো একটি আভিজাত্যপূর্ণ শহর।
শহরটি বাণিজ্যনগরীর পাশাপাশি ধীরে ধীরে সারা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম বিনোদন নগরীর মর্যাদাও অর্জন করতে সক্ষম হয়। কারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিপুল সমাহার কাজে লাগিয়ে রোমানরা এটিকে অপরূপ সজ্জায় সজ্জিত করতে পেরেছিল। গড়ে উঠেছিল নানা ধরনের বিনোদনকেন্দ্র, যার টানে সমগ্র পৃথিবীর ভ্রমণপিপাসু অভিজাত সমাজ ভিড় করতে থাকল সেখানে। সবাই অবসর কাটানোর জন্য ছুটে যেত প্রাচীনকালের আধুনিক সভ্যতার সব ধরনের চিত্তরঞ্জনের সমাহার থাকা এই প্রাণচঞ্চল শহরে। বণিক ও পর্যটকদের জন্য সেখানে গড়ে উঠেছিল অত্যাধুনিক দৃষ্টিনন্দন সব অট্টালিকা, প্রাসাদ আর প্রমোদকেন্দ্র। সহায়-সম্পদ আর বিত্ত-বৈভবের অভাব ছিল না পম্পেইবাসীর।
কিন্তু এত সব ধন সম্পদ, অর্থ বৈভবের মধ্যে ডুবে থেকেও পম্পেইবাসী ভুলে গেল মহান স্রষ্টাকে। ভুলে গেল তৎকালীন তাদের পালনীয় ধর্মকে। উদাসীন হলো স্রষ্টার আরোপ করা বিধি-নিষেধের প্রতি। ফলে তারা লিপ্ত হলো নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপে। নিজেদের চিত্তরঞ্জনের জন্য উদ্ভাবন করল ঘৃণ্যতম সব পন্থা ও মাধ্যমের। এমন সব আচরণ ও কার্যকলাপে তারা মেতে উঠল যেন প্রকৃতিই তাদেরকে দেওয়া ধন সম্পদ, বিত্ত বৈভব, সৌন্দর্য কেড়ে নিয়ে কঠিনতম শাস্তির ব্যবস্থা করতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল।
পম্পেইবাসীরা তাদের আমোদ প্রমোদের জন্য ঘৃণ্য বর্বরোচিত অসামাজিক সকল কার্যক্রম শুরু করেছিল। ব্যাভিচার, সমকামিতা, যৌনতাকে তারা এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। তারা ‘গ্ল্যাডিটোরিয়াল কমব্যাট’ এবং ‘সেক্স স্লেভারি’ এর মতো বিতর্কিত সব কাজ করতে শুরু করেছিল। ‘গ্ল্যাডিটোরিয়াল কমব্যাট’ হলো মাঠ বা গ্যালারির ভিতর দুই মানুষ বা পশুর আমৃত্যু লড়াই অর্থাৎ দুই জন পুরুষ এর মধ্যে একজন না মারা যাওয়া পর্যন্ত লড়াই বা মারামারি চলতে থাকবে আর দর্শকেরা তাদেরকে একে অপরকে মারার জন্য উৎসাহ প্রদান করে। আর ‘সেক্স স্লেভারি’ কে তারা পুরো এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। সমকামিতা থেকে শুরু করে তারা করত না এমন কোনো যৌনতা নেই, এমনকি বিভিন্ন পশুর সাথেও যৌনতাতে মেতে উঠত তারা। সবচেয়ে মর্মাহত করার মতো ব্যাপার হলো সেই বিনোদন ও তথাকথিত সাংস্কৃতিক নগরীতে ঘুরতে আসা পর্যটকদের আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা করে টাকা উপার্জনের জন্য সেখানকার গৃহকর্তা-কর্তীরা নিজেদের ছেলে মেয়েদেরকেও তাদের যৌনদাস-দাসী হিসেবে ভাড়া দিতেও কুন্ঠাবোধ করত না। এমনকি পম্পেইবাসীরা ‘ফারটিলিটি গড’ এর ও পূজা করত।
‘ফারটিলিটি গড’ হলো বর্তমান যুগের সেক্স টয় এর মতো। যারা যৌনতা ও সন্তান জন্মদান করতে অক্ষম ছিল তারা এই সব ফারটিলিটি গড নামক পুতুলের সাথে সেক্স করত এবং তাদের বিশ্বাস ছিল যে এর ফলে তারা তাদের অক্ষমতা দূর করতে পারবে। এসকল আচার-ব্যবহার দেখে তখনকার খ্রিস্টান ধর্মযাজক গণ ও ধর্মভীরু পরিবার পম্পেই ছেড়ে চলে যাওয়া শুরু করেন। কারণ পম্পেই এর রীতিনীতি, সংস্কৃতি সব এমন দিকে মোড় নিয়েছিল যে ধর্মপ্রাণ মানুষদের পক্ষে পম্পেই নগরীতে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এতে করে পম্পেই তখন একেবারেই ধর্ম ও ধার্মিক শূন্য হয়ে পড়ে।
একদিকে পম্পেইবাসীর এসব বিকৃত কর্মকাণ্ড বাড়তে লাগল, তার ঠিক অন্যদিকে প্রকৃতিও ধীরে ধীরে তার নির্মমতার বীজ বপন করতে লাগল ভিসুভিয়াস পাহাড়ের অভ্যন্তরের আগ্নেয়গিরির লার্ভা রূপে। প্রবাদে আছে, প্রকৃতি খুব সুন্দর বিচারক। অবশেষে প্রকৃতির বিচারের সেই নির্মমতার সময় উপস্থিত হলো আনুমানিক ৭৪ খ্রীস্টাব্দে ভরদুপুর বেলায়। প্রমোদে মত্ত পম্পেইবাসী তখন কেউ কেউ দুপুরের খাবার খাচ্ছে, কেউ বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউ বা ফূর্তিতে ব্যস্ত এমন সময় কোনো ধরনের পূর্ব সংকেত ছাড়াই ভিসুভিয়াস পাহাড়ের অভ্যন্তরীণ আগ্নেয়গিরি হাজার হাজার টন লার্ভা নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে এল নগরীতে। বলা হয়ে থাকে, এধরণের আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হওয়ার আগে সাধারণত পশু পাখিরা টের পায় এবং ছটফট করতে থাকে, কিন্তু সেইদিন নাকি এমন কিছুই হয় নি, সব পশু পাখিরা শান্তই ছিল।
ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী, শহরের পাশে অবস্থিত ভিসুভিয়াস পর্বতের আগ্নেয়গিরিতে শুরু হয় বিরাট ধরনের ক্যাটাস্ট্রোফিক অগ্ন্যুৎপাত, এ যেন প্রকৃতির রুষ্টতা, পর্বতমুখ থেকে যেন আগুনের গোলা আর অগ্নিবৃষ্টি ঝরে পড়তে থাকে পম্পেই শহর এর উপর, যাতে পম্পেই শহরসহ শহরের দুই লাখ অধিবাসী দিনদুপুরে মাত্র অল্প কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে অন্তত ৬৫-৭৫ ফুট অগ্নির লাভা আর ছাইভস্মের নিচে বিলীন হয়ে যায়। তাৎক্ষণিক জীবন্ত কবর রচিত হয় শহরের সব মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদসম্ভারের। এমনকি এই লার্ভা শহর ছাড়িয়েও সাগরের প্রায় ৯ মিটার গভীর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।
সংগত উল্লেখ্য, ১৯৪৪ সালেও ভিসুভিয়াস পর্বত থেকে আবারও আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটে এবং এতে প্রায় ১৯ হাজার মানুষ মারা যায়। তবে সেটা পম্পেই নগরীর মতো অতটা ভয়াবহ না। ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন পম্পেই শহর ধ্বংসের সময় যে পরিমাণ অগ্নিগোলক ও অগ্নিবৃষ্টি বর্ষণ হয়েছিল তা যেকোনো পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের থেকেও বেশি ভয়াবহ। টানা ২০ ঘন্টা ধরে ঘটেছিল সেই অগ্নিবর্ষণ। এর পর থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত শত শত বছর ধরে আধুনিক মানবসভ্যতার অন্তরালে, অগোচরেই রয়ে যায় এই অভিশপ্ত, পাপে পরিপূর্ণ পম্পেই শহরটি। কিন্তু ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে কিছু অ্যামেচার আর্কিওলজিস্ট সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন ধ্বংস হয়ে যাওয়া সেই পম্পেই নগরী। শুরু হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে ধ্বংসলীলা থেকে মমি হয়ে থাকা মৃতদেহ আর অভাবনীয় সব স্থাপনা উদ্ধারের মহাযজ্ঞ।
আর ধীরে ধীরে সেখানে বাড়তে থাকে উৎসাহী জনতার আনাগোনা। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, দুই হাজার বছরের পুরনো এই ধ্বংসলীলা থেকে এখনো অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায় সব মৃতদেহ। হয়তো কেউ পরিবার নিয়ে দুপুরের খাবারের সামনে, কেউ রাস্তায়, বাড়ির সামনে কুকুরটাও যেভাবে বসে থাকে ঠিক সেইভাবেই অবিকৃত অবস্থায় সব মমি পাওয়া যায়, যেন স্রষ্টার নিজস্ব সৃষ্টি করা জীবন্ত মমি মূর্তি। দেখে খুব অবাক হতে হয়। এখন পর্যন্ত এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্যটন কেন্দ্র এবং প্রতি বছর প্রায় ২৫ বিলিয়ন পর্যটক পম্পেই নগর পরিদর্শনে যান।কালের বিবর্তনে কয়েক হাজার বছরের পুরনো সেই পর্যটনকেন্দ্র আবার পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ইতালি সরকার এই পম্পেই নগরীকে জাদুঘর ও পর্যটনকেন্দ্র বানিয়েছে। হাজার বছর আগের ইতিহাস ও অভিশপ্ত নগরী যেন সামনে আরও হাজার বছর ধরে মানুষকে শিক্ষা দেবে।