শ্রাবনে বৃষ্টির দেখা নেই বিপর্যস্ত কৃষি ও জনজীবন
প্রকাশিত : ২১ জুলাই ২০২৩
ঈশিত জাহান: ষড় ঋতুর বাংলাদেশ আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুইমাস বর্ষাকাল। শ্রাবনের প্রথম সপ্তাহ পার হতে চললেও দেখা নেই বর্ষার। বিগত বছরে এমন সময় দেশের মাঠ, ঘাট, খাল,নদী পানিতে থৈ থৈ করতো। কৃষক লাঙ্গল নিয়ে আমন ধানের বীজতলা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাতো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বদলে গেছে দেশের প্রকৃতি। বর্তমানে বর্ষা মৌসুম হলেও বৃষ্টির দেখা নেই। চৈত্র মাসের মতো তীব্র তাপদাহ বইছে দেশজুড়ে। তীব্র গরমে অতিষ্ঠ জন জীবন। বিপর্যস্ত কৃষি। শুধু বাংলাদেশেই নয়; বিশ্ব জুড়ে বিরূপ আবহাওয় বিরাজ করছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
শুক্রবার আবহাওয়া অধিদপ্তর পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানিয়েছে, দেশের একটি বিভাগ ও পাঁচটি জেলার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বা দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় তা প্রশমিত হতে পারে। পূর্বাভাসে সিনপটিক অবস্থা নিয়ে বলা হয়েছে, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন এলাকায় সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপটি বর্তমানে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন ওড়িশা উপকূলীয় এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমী বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ, ওড়িশা, লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশে কম সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরের অন্যত্র মাঝারি অবস্থায় রয়েছে।
দাবদাহের বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজশাহী, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, কিশোরগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলা এবং রংপুর বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা কিছু জায়গা থেকে প্রশমিত হতে পারে। গতকাল দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল রাজশাহীতে ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল বান্দরবান ২৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি।
তাপমাত্রার বিষয়ে পূর্বাভাসে জানানো হয়, সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা তথা শনি থেকে সোমবার পর্যন্ত আবহাওয়ার পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গা এবং রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি বর্ষণ হতে পারে।
উপক‚লীয় বরগুনা জেলার কৃষকরা করিম মৃধা জানিয়েছেন, প্রচÐ গরম ও রোদে মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি না হওয়ায় আমনের বীজতলা তৈরি করতে পারছেন। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে এখানকার জনজীবন। তীব্র গরমে কর্মমুখী মানুষ পড়েছে মহা বিপদে।
গত চার বছরের মধ্যে এবার রাজশাহীতে আষাঢ় মাসে সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। তাই আউশের খেত পানিতে ভরেনি। বাড়তি দামে সেচের পানি দিতেই তা হারিয়ে যাচ্ছে। খরায় জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। পানির অভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে আমন রোপণ। পাট জাগ দেওয়ার পানি নেই। কোথাও কোথাও খরায় পুড়ে যাচ্ছে খেতের পাটগাছ ও গ্রীষ্মকালীন ভুট্টাখেত। ধানের জন্য বিখ্যাত দিনাজপুরে খরার কারণে এখন পর্যন্ত কাঙ্খিত জমিতে আমন রোপণ করা সম্ভব হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রংপুর অঞ্চলেও পড়ছে। বৃষ্টি না হলে পাট নিয়ে কৃষককে ভুগতে হবে। আমন রোপণ বিলম্বিত হচ্ছে।
নওগাঁর মান্দা উপজেলার কৃষক রহিম মিয়া বলেন, গত বছর আউশের জমিতে সেচ খরচ ছিল ৬০০ টাকা। এবার ২০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। তারপরও জমিতে পানি দিতেই শুকিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, খরায় এলাকার জমির পাটগাছ পুড়ে যাচ্ছে। তাদের শিব নদীতে এক হাঁটুর চেয়ে কম পানি। এলাকার চাষিরা পাট ডোবানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু বৃষ্টি না হলে সেই পানিতে পাট পচবে না।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় চলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রংপুর অঞ্চলেও পড়ছে। বৃষ্টি না হলে পাট নিয়ে কৃষককে ভুগতে হবে। আমন রোপণ বিলম্বিত হচ্ছে। অন্যান্য ফসল নিয়েও ভুগতে হবে।
এদিকে বিশ্বের গড় তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙ্গেছে চলতি মাসে। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে আমেরিকার বেশ কিছু অঞ্চলেও ভয়াবহ গরম মোকাবিলা করছেন মানুষ। এই পরিস্থিতিতে সামনে এসেছে ভয়ঙ্কর তথ্য। বলা হচ্ছে, চলমান জুলাই মাস হতে পারে শত শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ মাস। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নাসার এক বিশেষজ্ঞ এ তথ্য জানিয়েছেন। গতকাল বার্তাসংস্থা এএফপি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জুলাই ‘হাজার বছরের মধ্যে না হলেও শত শত বছরের মধ্যে’ সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস হবে বলে মন্তব্য করেছেন নাসার শীর্ষ জলবায়ুবিদ গ্যাভিন শ্মিট। এএফপি বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মেইন ইউনিভার্সিটির পরিচালিত সরঞ্জামের হিসাব অনুসারে ইতোমধ্যেই এই গরম ও তাপপ্রবাহের দৈনিক রেকর্ডগুলো ভেঙে গেছে।
গ্যাভিন শ্মিট বলেন, যদিও এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সামান্য মতভিন্নতা রয়েছে তারপরও প্রচÐ তাপের প্রবণতাটি সন্দেহাতীত এবং এই বিষয়টি সম্ভবত মার্কিন সংস্থাগুলোর প্রস্তুতকৃত মাসিক প্রতিবেদনে আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিফলিত হবে। তিনি আরো বলেন, আমরা সারা বিশ্বে অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। আমরা ইউরোপে, চীনে এবং যুক্তরাষ্ট্রে যে তাপপ্রবাহ দেখছি তা আসলে সব রেকর্ড ভেঙে ফেলছে। তাপপ্রবাহের এই প্রভাবগুলোর জন্য শুধুমাত্র এল নিনোর আবহাওয়ার ধরণকে দায়ী করা যায় না। মূলত এটি ‘সত্যিই কেবলমাত্র আবির্ভূত হয়েছে’। গ্যাভিন শ্মিট বলেন, বর্তমান তাপপ্রবাহের পেছনে যদিও এল নিনো ছোট ভূমিকা পালন করছে, তারপরও ‘আমরা যা দেখছি তা হলো- প্রায় সর্বত্রই সামগ্রিকভাবে উষ্ণতা বেড়েছে। বিশেষ করে মহাসাগরগুলোতে। আমরা অনেক মাস ধরে সমুদ্র পৃষ্ঠের রেকর্ড-ব্রেকিং তাপমাত্রা দেখছি। এমনকি সেটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের বাইরেও’।
এএফপি বলছে, বিশ্বে এখন যা হচ্ছে তাতে ২০২৩ সাল যে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ বছর হবে তেমন সম্ভাবনা দিনে দিনে বাড়ছে। গ্যাভিন শ্মিট অবশ্য তার হিসাবের ওপর ভিত্তি করে বর্তমানে তেমন কোনো সম্ভাবনাকে ‘ফিফটি-ফিফটি’ বলছেন। যদিও তিনি বলছেন, অন্য বিজ্ঞানীরা এমন সম্ভাবনাকে ৮০ শতাংশের মতো উচ্চতায় রেখেছেন। এছাড়া চলতি বছরের তুলনায় ২০২৪ সাল আরও বেশি উষ্ণ বছর হবে বলেও নিজের আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন নাসার শীর্ষ এই জলবায়ুবিদ।