জিপিএ-৫ পাওয়া সুমাইয়ার পড়াশোনা চালানো নিয়ে সংশয়
প্রকাশিত : ৩০ জুলাই ২০২৩
এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল অর্জনকারীরা যখন আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠেছে তখন উল্টো চিত্র মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া সুমাইয়া আক্তারের বাড়িতে। ভালো ফলের খবর পেয়ে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েই তার বাবা ফিরে যান নিজ পেশা ভ্যান চালাতে। মাদারীপুরের শিবচরের পাঁচ্চর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অতি দরিদ্র ভ্যান চালকের মেয়ে মেধাবী এ শিক্ষার্থী এখন ভালো কলেজে ভর্তির প্রস্তুতির পরিবর্তে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার চিন্তায় উদ্বিগ্ন।
সরেজমিনে জানা যায়, শিবচরের মাদবরচর ইউনিয়নের লপ্তিকান্দি গ্রামের দরিদ্র ভ্যান চালক মো. হবি মোল্লা ও তাসলিমা বেগমের চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয় মেয়ে সুমাইয়া আক্তার। পদ্মা নদীর ব্যাপক ভাঙনের শিকার হয়ে চরজানাজাত থেকে এ এলাকায় এসে বছরে পাঁচ হাজার টাকা খাজনায় এক টুকরো জমি ভাড়া নিয়ে দোচালা ঘর তুলে বসত গড়ে হবি মোল্লার পরিবার। ভ্যান চালক হবি মোল্লার উপার্জনে কোনোরকমে তাদের সংসার চলে। তার মধ্যে বড় মেয়েকে বিয়ে দিলেও বাচ্চা হওয়ার পর স্বামী তাকে তাড়িয়ে দেয়। পরে সে আশ্রয় নিয়েছে বাবার বাড়িতে। সব মিলিয়ে সংসার চালাতে খুব বেগ পেতে হয় তাদের।
দিন এনে দিন খাওয়া পরিবারটির কাছে লেখাপড়া স্বপ্নের মতো হলেও সুমাইয়ার ছিল অদম্য ইচ্ছাশক্তি। প্রতিদিন আধা ঘণ্টার মতো পায়ে হেঁটে স্কুলে যেত সে, ফিরতও একইভাবে। ৯ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মা-বাবা বিয়ে ঠিক করলে সুমাইয়া প্রধান শিক্ষকের কাছে আশ্রয় নেন, তার আশ্বাসে ও সহায়তায় চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় সে। ফরম ফিলআপের টাকাও দেন প্রধান শিক্ষক। সব বই না থাকায় সহপাঠীদের কাছ থেকে বই নিয়ে পড়ত অদম্য সুমাইয়া।
পরীক্ষা চলাকালে সুমাইয়াকে বিশেষ কোনো খাবারও দিতে পারেনি পরিবার। হাতেগোনা দুটো ড্রেস পরার মতো রয়েছে তার। শুধু তাই নয়, পরীক্ষায় ভালো ফলের পরও তার বাবা বাড়িতে মিষ্টি আনতে পারেননি। সুমাইয়ার বাড়িতে গেলে কথা হয় তার মায়ের সঙ্গে। মেয়ে কোথায় পড়তে চায়– জানতে চাইলে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যান তিনি। সেসময় পাশে বসে ওড়না দিয়ে চোখ মুছছিল সুমাইয়া। সে জানায়, সুযোগ পেলে ঢাকায় ভিকারুননিসা কলেজে পড়তে চায়। কিন্তু অর্থাভাবে কলেজে ভর্তি ও যাতায়াত ব্যয় নিয়ে শঙ্কিত পরিবারটি।
সুমাইয়ার মা তাসলিমা বেগম বলেন, আমরা কোনোদিন সুমাইয়াকে পারিনি ভালো কোনো খাবার খাওয়াতে। অনেক দূরের স্কুলে যেত পায়ে হেঁটে। কখনো ওর বাবা পৌঁছে দিত। আমার মেয়ের স্বপ্ন অনেক বড়। কিন্তু ওর স্বপ্নপূরণ করার সাধ্য আমাদের নেই। একবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু স্কুলের হেড স্যার দিতে দেননি। ওর লেখাপড়া চালানোর জন্য অনেক সহযোগিতা করেছেন স্যারেরা। এখন ওর ভবিষ্যৎ লেখাপড়া কীভাবে চালাব সেটাই বুঝতে পারছি না। সবাই সহযোগিতা করলে হয়ত আমার মেয়ের স্বপ্নপূরণ হবে।
সুমাইয়ার বাবা মো. হবি মোল্লা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। তখন অন্যের ক্ষেতে কামলা দিয়ে টাকা ঋণ করে একটা ভ্যান কিনেছি। ভ্যান চালিয়ে কোনোরকমে সাতজনের সংসার চালাই। মেয়েটাকে কোনো দিন ভালো একটা ড্রেস কিনে দিতে পারিনি। স্কুলের স্যারেরা সাহায্য না করলে ওর লেখাপড়াই হতো না। এখন কীভাবে ভালো কলেজে ভর্তি করব বুঝতে পারছি না। ওর স্বপ্ন অনেক বড় কলেজে পড়ার। আমি সবার সহযোগিতা চাই।
অদম্য মেধাবী সুমাইয়া আক্তার বলেন, স্কুলের হেড স্যারসহ অন্য স্যারদের সহযোগিতা না পেলে ভালো ফল দূরের কথা আমার লেখাপড়া করাই হতো না। আমার বাবা ভ্যান চালিয়ে অনেক কষ্ট করে আমাদের সংসার চালান। আমি যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি তখন ফরম ফিলআপসহ অন্য খরচের চিন্তায় আমার লেখাপড়া বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পরিবার। তখন হেড স্যারকে বললে তিনি আমার ফরম ফিলআপের দায়িত্ব নেন। খাতা, কলম, বই দিয়েছেন। আমার ইচ্ছা ঢাকায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের পক্ষে এত খরচ চালানো সম্ভব না। কীভাবে লেখাপড়া চালিয়ে নেব কিছুই বুঝতে পারছি না।
পাঁচ্চর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ সামসুল হক বলেন, সুমাইয়া খুবই মেধাবী একজন শিক্ষার্থী। তবে অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় ওর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া খুবই কষ্টকর ছিল। সুমাইয়া বিষয়টি আমাকে জানানোর পর আমি বিভিন্ন সময়ে তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি, ফরম ফিলআপ করিয়ে দিয়েছি। এসএসসি পরীক্ষায় সে ভালো ফল অর্জন করেছে, এতে আমরা খুুব আনন্দিত।
তিনি বলেন, সুমাইয়ার ভবিষ্যৎ লেখাপড়ার খরচ বহন করা ওর পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সমাজের বিত্তবান মানুষরা যদি সহযোগিতার হাত বাড়ায় তবে মেধাবী সুমাইয়া ভবিষ্যতে অনেক বড় স্থানে জায়গা করে নেবে বলে আমার বিশ্বাস।