ঝালকাঠিতে আম্ফানে সব হারিয়ে নিঃস্ব অনেক পরিবার

প্রকাশিত : ২৩ মে ২০২০

রহিম রেজা, ঝালকাঠি থেকে: উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠির দুর্গম এলাকা কাঁঠালিয়া উপজেলার লঞ্চঘাট। বিষখালী নদী তীরের অরক্ষিত বেড়িবাঁধের পাশেই লঞ্চঘাটের পল্টুন। সেখানে ছোট একটি দোকান দিয়ে কোন রকমের সংসার চলতো আলমগীর হোসেনের (৪২)। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে চার-পাঁচ ফুট পানি বেড়ে যাওয়ায় পাঁচ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। সেই সঙ্গে ভেঙে যায় আলমগীরের স্বপ্ন।

ছোট দোকানটি ভেঙে পড়ে আছে নদী তীরে। বৃষ্টিতে ভিজে মালামাল সব নষ্ট হয়ে যায়। দুইদিনের আপ্রাণ চেষ্টায় ভাঙা দোকানটি দাঁড় করাতে পারলেও লক্ষাধিক টাকার মালামাল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন তিনি। বেড়িবাঁধের ভাঙা স্থানে বসে নিশ্চুপ মধ্য বয়সী আলমগীর চোখের পানি ফেলছেন। শুক্রবার দুপুরে কাঁঠালিয়া লঞ্চঘাট এলাকায় গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিডর থেকে আম্ফান পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩ বছরেও বেড়িবাঁধটি নির্মাণ করা হয়নি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এমপি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। আমরা গরিব মানুষ, সারা জীবন গরিব থাকবো। মানুষের কাছে হাত পাতবো, এ ছাড়া উপায় নাই।

জামা কাপড় কেনা-তো দূরের কথা, ঈদের দিন একটু সেমাই রান্না করার মতো কোন সামর্থ্য আমার নেই। দোকান থেকে ৭ মিনিটের পথ হাটলেই কাঁঠালিয়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, তিন সন্তান নিয়ে ঘরে বসে আছেন আলমগীরের স্ত্রী রেকসনা বেগম। রেকসনা বলেন, ঝড়ের রাইতে মাইয়া পোলা লইয়া আশ্রয়কেন্দ্রে যাই। সকালে খবর পাই আমার স্বামীর বেড়িবাঁধের দোকান ভেঙে গেছে। তিন সন্তানের পুরান কাপড়েই ঈদ করতে হইবে। এখন খুবই অসহায় হয়ে পড়েছি। আল­াহ ছাড়া আমাগো কেউ নাই। আলমগীরের বাড়ি থেকে কিছুদূর গিয়ে দেখা হয় ইঞ্জিন চালিত ট্রলার চালক রফিকুল ইসলামের (৪৫) সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় শুনে কিছু বলার আগেই কেঁদে ফেললেন।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, লঞ্চঘাট দিয়ে বিষখালী নদীর ওপার বরগুনার বেতাগী উপজেলা। আমার একটি যাত্রীবাহী ট্রলার ছিলো। সেই ট্রলারে যাত্রী নিয়ে নদীর এপার ওপার পারি দিতাম। যা আয় হতো, তা দিয়েই চলতো সংসার। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের রাতে আমার ট্রলারের ওপর গাছ পড়ে পানিতে তলিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ট্রলারটি পাওয়া যায়নি। সেই থেকে রোজগার বন্ধ। দুই দিন ধার উদ্ধার করে সংসার চালাচ্ছি। আমার মতো অসহায় মানুষ এ গ্রামে নাই। সামনে ঈদের দিন সন্তানদের সামনে দাঁড়ানোর সাহস হারিয়ে ফেলেছি।

না খাইয়া থাকতে পারবো, কিন্তু বেড়িবাঁধ না থাকলে ঘরবাড়ি সব নদীতে যাবে, তখন করবো কী! আমাদের বেড়িবাঁধে ব্লক দিয়ে স্থায়ী ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছি। লঞ্চঘাটের পাশেই বাড়ি সনিয়া বেগমের (৫০)। তাঁর কাছে শোনা গেল ঘূর্ণিঝড়ের রাতের ঘটনা। সন্ধ্যা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত যা ঘটেছিল, তার বর্ণনা দিলেন তিনি। সন্ধ্যা থেকে বাতাস শুরু হয় প্রচন্ড বেগে। বাড়তে শুরু করে নদীর পানি। মুহূর্তেই পানিতে থৈ থৈ। অঝোরে পড়ে বৃষ্টি। বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে বসতঘর ও গাছপালার মাটি নরম হতে থাকে। অনেকগুলো গাছ পড়ে যায়। বসতঘরটিও নড়বড়ে অবস্থা। দুই সন্তান নিয়ে চলে যাই উপজেলা পরিষদের অডিটরিয়ামের আশ্রয়কেন্দ্রে।

পরের দিন সকালে এসে দেখি গাছপালা পড়ে বসতঘরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরটি এখনো ঠিক করাতে পারিনি, ঈদের আনন্দ আমাদের নেই। এবারের ঈদ বিষাদে পরিণত হয়েছে। রফিক, আলমগীর, সনিয়ার মতো কাঁঠালিয়া উপজেলার অসংখ্য মানুষ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, এ উপজেলায় পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ভেঙে গেছে ছোট বড়, কাঁচা আধাপাকা ১৮০টি বসতঘর।

ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন, আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করেছি। ইতোমধ্যে অনেকের মাঝে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকেই সহযোগিতা করা হবে। বিষখালী নদীর বেড়িবাঁধটি নির্মাণের জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দিয়েছি। আশা করি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

আপনার মতামত লিখুন :