খাল, বিল, হাওড়-বাঁওড় ও জলাশয়ের মতোই বিলুপ্তির পথে জাতীয় ফুল শাপলা

প্রকাশিত : ১৬ জুন ২০২০

রণজিৎ মোদক : “কাটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে/ দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে”। দুঃখ বিনা কোনো কিছুই লাভ করা সম্ভব নয়। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ রয়েছে, লাইফ ইজ নট এ বেড অফ রোসেস। জীবন পুষ্পশয্যা নয়। এ কথা সবার জানা। জানা সত্তে¡ও অনেকেই আমরা সে কথায় কর্ণপাত করি না। যার ফলে, অভাব আমাদের বার বার পিছু টানে। বর্তমান মিডিয়ার যুগে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি। আর জেনে তা থেকে অনেকেই শিক্ষা নিচ্ছি। হাঁস, মুরগী গবাদি পশু প্রতিপালন করে অথবা মৎস্য চাষ কিংবা বৃক্ষ লাগিয়ে অনেকেই সুখের ছোঁয়া পেয়েছেন। আর মূলধন ছাড়াও অনেকে ব্যবসা করে জীবন জীবিকা পরিচালনা করছেন।

নদী মাতৃক বাংলাদেশ। এই শাপলা ফুল সাধারণত ভারত উপমহাদেশে দেখা যায়। এই উদ্ভিদ প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। থাইল্যান্ড ও মায়ানমারে এই শাপলা ফুল পুকুর ও বাগান সাজাতে খুব জনপ্রিয়। সাদা শাপলা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইয়েমেন, তাইওয়াান, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার প্রভৃতি দেশের পুকুর ও হ্রদে দেখা যায়। এই ফুল পাপুয়া নিউগিনি এবং অস্ট্রেলিয়ার কিছু এলাকায় ও দেখা যায়। এই ফুল যেমন দেখা যায় চাষের জমিতে, তেমনই হয় বন্য এলাকায়। কাটা ধান ক্ষেতের জমে থাকা অল্প পানিতে এই ফুল ফুটে থাকতে দেখা যায়। বিশ্বে এই উদ্ভিদের প্রায় ৩৫টি প্রজাতি পাওয়া গেছে। শাপলা ফুল অনেক রঙের হলেও কেবল সাদা শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে।

এছাড়াও বাংলাদেশের পয়সা, টাকা, দলিলপত্রে জাতীয় ফুল শাপলা বা এর জলছাপ আঁকা থাকে। এই ফুল শ্রীলংকারও জাতীয় ফুল। শ্রীলংকায়ও এই ফুল ‘নীল মাহানেল’ নামে পরিচিত। শ্রীলংকার ভাষায় নীল থেকে এই ফুলকে ইংরেজিতে অনেক সময় ‘বøু লোটাস’। শ্রীলংকায় বিভিন্ন পুকুর ও প্রাকৃতিক হৃদে এই ফুল ফোটে। এই জলজ উদ্ভিদের ফুলের বিবরণ বেশ কিছু প্রাচীন বই যেমন- সংস্কৃত পালি ও শ্রীলংকান ভাষার সাহিত্যে প্রাচীনকাল থেকে “কুভালয়া”, “ইন্ধিয়ারা”, নীলুপ্পালা, নীলথপালা, নীলুফুল নামে পাওয়া গেছে যা শ্রেষ্ঠত্ব, শৃংখলা, পবিত্রতার প্রতীক। শ্রীলংকার বুদ্ধদের দৃঢ় বিশ্বাস গৌতম বুুদ্ধের পায়ের ছাপে পাওয়া ১০৮ টি শুভ চিহ্নের মাঝে একটি ছিল এই শাপলা ফুল। মানুষ এই ফুল খেত, আঁকত এবং শ্রদ্ধা করত। কথিত আছে ভারতে হিন্দুদের সর্প দেবী মনসা পূজায় শাপলা ফুল দেয়া হয়। সৃষ্টির আধিতত্তে¡ জানাযায় ব্রহ্মবর্ত্য পূরাণে ব্রহ্মার সৃষ্টি হয়েছে এই পদ্ম (শাপলা) ফুল থেকে।

বিল-ঝিল নি¤œাঞ্চল জলবেষ্টিত এলাকায় বর্ষা মওসুমে শাপলা শালুক অনেকেরই হৃদয় আকৃষ্ট করে। আর শাপলা হচ্ছে আমাদের জাতীয় ফুল। এই শাপলা বিক্রি করে সম্বলহীন অনেক পরিবার সংসার পরিচালনা করে থাকে। শাপলা ব্যবসায়ীদের শাপলা কিনতে হয় না। একটু কষ্ট করে হাত বাড়ালেই মুঠি মুঠি পাওয়া যায়। ঋতু বৈচিত্রের দেশে অলসতাই অভাবের কারণ রূপে প্রতীয়মান হচ্ছে। স্বভাবত বাংলাদেশের মানুষ অলস জীবন কাটাতে ভালবাসে। অলসতা এক শ্রেণীর মানুষের কাছে বিলাসবহুল জীবনের প্রতীক বলে মনে করেন। তারা গর্ববোধও করেন। অথচ জাপান চীন অন্যান্য দেশের মানুষ পরিশ্রমী। তারা অলসতা কাকে বলে তা জানেনই না। বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানুষ অলসতাকে জয় করে নিজেরা নিজেদের ভাগ্য গড়ে নিচ্ছেন। গ্রাম বাংলার হাটে-ঘাটে শহর ও শহরতলী এলাকায় বর্ষাকালীন সময় শাপলা ব্যবসায়ীদের শাপলা বিক্রি করতে দেখা যায়। শাপলা যেমন বিল-ঝিলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। শাপলা সবজি হিসেবেও যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। শাপলার ডাটা ভাজি বেশ উপাদেয় এবং সুস্বাদু। সবজির দুর্মূল্যের বাজারে শাপলা ডাটা সবজি রূপে বেশ স্থান দখল করে নিয়েছে। আর এই শাপলা বিক্রি করে দরিদ্র শ্রেণীর কতিপয় উদ্যমী পুঁজিহীনরা সংসার পরিচালনা করছে। নদী ঘেরা নারায়ণগঞ্জ জেলার অধিকাংশ হাট-বাজারে শাপলা বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে।

বক্তাবলী গুচ্ছ গ্রামের দরিদ্র সিরাজ মিয়া বর্ষাকালীন সময় শাপলা বিক্রি করে সংসার চালিয়ে আসছে। শাপলার শালুক উপাদেয় খাবার। গ্রাম বাংলার অনেক দরিদ্র পরিবার শালুক সিদ্ধ করে খেয়ে থাকেন। তাছাড়া অনেক সৌখিন পরিবারের সদস্যরাও শালুক এবং শাপলা ডেপ এর খৈ এর মুড়ি ও মুড়কি শখের খাবার হিসেবে খেয়ে থাকেন। পরিকল্পনা মাফিক শাপলা চাষ করা হলে, সবজি ও খাদ্যের আংশিক চাহিদা মিটাতে সক্ষম বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। বর্ষা মওসুমে কৃষি জমিতেও শাপলা চাষ করা যেতে পারে। বিশেষ করে নিচু জলা জমিগুলোতে শাপলা চাষ লাভজনক ব্যবসায় রূপ নিতে পারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই খাদ্য চাহিদার যোগান দিতে নতুন নতুন পরিকল্পনা পূর্ব থেকে গ্রহন করা প্রয়োজন। শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। এই শাপলা প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধির সাথে সাথে নি¤œবৃত্ত মানুষের রোজগারের সম্বল হিসেবে জীবন বাঁচিয়ে রাখছে। এই শাপলাকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।

লেখক-
রণজিৎ মোদক
শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সভাপতি, ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব
ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ।

আপনার মতামত লিখুন :