ইরানের পরমাণুসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ‘রহস্যময়’ হামলার পেছনে কারা?

প্রকাশিত : ৮ জুলাই ২০২০

সম্প্রতি ইরানের বেশ কয়েকটি স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব স্থাপনার একটি নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্র। এসব ঘটনা কি নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা? এ নিয়ে প্রতিবেদনটি লিখেছেন বিবিসির পার্সিয়ান বিভাগের সাংবাদিক জিয়ার গোল।

জুন মাসের ৩০ তারিখ মধ্যরাতের পরপরই আমার ইনবক্সে একটি ই-মেইল এলো। অপরিচিত একটি গ্রুপ থেকে এটি পাঠানো হয়েছে, যাঁরা নিজেদের নাম ‘হোমল্যান্ড চিতাস’ বলে দাবি করছে। গ্রুপটি বলছে যে তারা ঘণ্টা দুয়েক আগে স্থানীয় সময় রাত ২টায় ইরানের বড় একটি পরমাণু স্থাপনা নাতাঞ্জে আক্রমণ করেছে। ই মেইলে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে যে একটি স্থাপনা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে – যা ইরান সরকার গোপন করে রাখতে সক্ষম হবে না। গ্রুপটি দাবি করছে, ইরানের সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ভিন্নমতাবলম্বী সদস্যদের নিয়ে এটি গঠিত হয়েছে।

তারা বলছে, এর আগেও তারা অসংখ্য হামলার পেছনে ছিল; কিন্তু ইরানি কর্তৃপক্ষ সব সময় সেগুলো জনগণের কাছে গোপন রেখেছে। সর্বশেষ হামলার খবরটি যাচাই করে দেখতে আমি ইরানের বিভিন্ন বার্তা সংস্থা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্ভরশীল উৎসগুলোতে এর সন্ধান করি। কিন্তু কোথাও আমি এ ধরনের হামলার কোনো উল্লেখ দেখিনি। এর কয়েক ঘণ্টা পরে ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থা ঘোষণা করে যে নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রে একটি ঘটনা ঘটেছে, তবে এটা যে নাশকতামূলক কাজ- এমন অভিযোগ তারা প্রত্যাখ্যান করে।

পরের দিন ইরানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সংস্থা সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল ঘোষণা করে যে নাতাঞ্জে কী কারণে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা তারা জানে, কিন্তু নিরাপত্তার কারণে আপাতত তারা সেটা প্রকাশ করছে না। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতেও দেখা যায় যে রাত ২টা ০৬ মিনিটে নাতাঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে সেখানে যে ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার সাথে ই-মেইলে দেওয়া বিস্তারিত বিবরণের মিল পাওয়া যায়।

গ্রুপটির ই-মেইল খুব সতর্কভাবে লেখা হয়েছে। এর সঙ্গে কৌশলগত স্থাপনায় হামলার বিষয়ে প্রচারণাধর্মী একটি ভিডিও-ও যুক্ত করা হয়েছে। এই ভিডিওটিতে দাবি করা হয়েছে যে ইরানের ভেতরেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। এ ধরনের বিবৃতি ও ভিডিও তৈরি করতে কয়েক দিন না হলেও কয়েক ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন। যারাই এটা তৈরি করুক না কেন, তারা নাতাঞ্জে বিস্ফোরণের কথা আগে থেকেই জানত। নাতাঞ্জের হামলাটি ‘নাশকতামূলক’ এই তত্ত্বকেই এসব সমর্থন করে। আবার এ-ও হতে পারে যে হামলাকারীর বিষয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করতে এই ই-মেইলটি পাঠানো হয়েছে। হতে পারে ইরানের সরকারবিরোধী বিদেশি কোনো গোয়েন্দা শক্তি হয়তো হামলাটি চালিয়েছে।

হামলা ‘প্রতিহত’ করা হয়েছে :

গ্রুপটির নাম হোমল্যান্ড চিতাস। এ ধরনের গ্রুপের মধ্যে রয়েছে পার্সিয়ান ক্যাট অথবা চার্মিং কিটেন। অনেকেই মনে করেন, হ্যাকারদের এই গ্রুপটি ইরানের রেভলুশনারি গার্ড সাইবার আর্মির একটি অংশ। এমন সম্ভাবনাও রয়েছে যে হোমল্যান্ড চিতাস গ্রুপের জন্ম হয়েছে পার্সিয়ান ক্যাটকে মোকাবেলা করার জন্য।

মে মাসের শেষের দিকে, ইরানের চিরশত্রু ইসরায়েলের জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিল বলেছে যে তারা তাদের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর করা একটি বড় ধরনের সাইবার হামলা প্রতিহত করেছে। তাদের বিশ্বাস ওই হামলাটি ইরান থেকেই করা হয়েছিল। এর কয়েক দিন পর ইরানের দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর শহিদ রাজায়ের ওপর সাইবার হামলা চালানো হয়। ইরানের মোট সামুদ্রিক আমদানি-রপ্তানির ৫০ শতাংশেরও বেশি করা হয় এই বন্দর দিয়ে।

এই হামলার ফলে জাহাজ আসার খালগুলোতে পানি আটকে গিয়ে টার্মিনালের সাথে যুক্ত রাস্তাগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। ইরানি কর্মকর্তারা এর জন্য বিদ্যুৎসংকটকে দায়ী করেছেন। কিন্তু পশ্চিমা গোয়েন্দা সূত্রগুলোর বিশ্বাস- প্রতিশোধ হিসেবেই ইসরায়েল ইরানের ওপর এই হামলাটি চালিয়েছে।

আগুন ও বিস্ফোরণ :

গত তিন মাসে ইরানের স্পর্শকাতর কিছু স্থাপনায় ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় রহস্যজনক কিছু হামলা চালানো হয়েছে। সারা দেশে পারমাণবিক, বিদ্যুৎ, তেল শোধনাগার, বড় বড় কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গত দু’সপ্তাহে এ রকম বেশ কিছু ঘটনার তালিকা :

২৬ জুন : তেহরানের কাছে পারচিনের খোজির এলাকায় তরল জ্বালানি উৎপাদনের একটি স্থাপনায় বিস্ফোরণ। ব্যালিস্টিক মিসাইলের জন্য এখানে জ্বালানি উৎপাদন করা হয়; শিরাজ বিদ্যুৎকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডের পর বিদ্যুৎসংকট।

৩০ জুন : তেহরানের একটি চিকিৎসা ক্লিনিকে বিস্ফোরণ, ১৯ জন নিহত।

২ জুলাই : নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রে বিস্ফোরণ ও আগুন

৩ জুলাই : শিরাজে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড।

৪ জুলাই : আহওয়াজ বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ও আগুন; মাশাহারে কারুন পেট্রকেমিক্যাল কারখানায় ক্লোরিন গ্যাস লিক।

ফিনল্যান্ডে থাকেন এমন একজন ইরানি সাংবাদিক সাঈদ আগাঞ্জি, যিনি এই ঘটনাগুলোর ওপর নজর রাখছেন, তিনি বলেছেন- এসব অস্বাভাবিক ঘটনা এবং এগুলো উদ্দেশ্যমূলক হতে পারে। তিনি বলেন, ইরানের এসব কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্থাপনায় হামলার লক্ষ্য হচ্ছে ইরানের অর্থনীতি ধ্বংস করা, যাতে ইরানি সরকার মিলিশিয়া গ্রুপগুলোকে অর্থ দিতে না পারে এবং এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের গতি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন আনা।

পারচিন এবং খোজির ইরানের দুটি সামরিক স্থাপনা। ধারণা করা হয়, এর ভেতরে পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের কাজ হয়। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএর পরিদর্শকদের কখনো পারচিন স্থাপনায় যেতে দেওয়া হয়নি। অনেকের সন্দেহ যে ইরান সেখানে পরমাণু অস্ত্র তৈরির বড় ধরনের কিছু পরীক্ষা চালিয়েছে।

ইরানের সতর্কতা :

ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনা বলেছে, নাতাঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ‘শত্রু দেশ, বিশেষ করে জায়নবাদী সরকার (ইসরায়েল) ও যুক্তরাষ্ট্রের’ নাশকতামূলক কাজ হতে পারে। ইরানের বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রধান বলেছেন, এই ঘটনা নাশকতামূলক সাইবার হামলা হিসেবে প্রমাণিত হলে এর প্রতিশোধ নেওয়া হবে।

গত রবিবার মধ্যপ্রাচ্যের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন যে নাতাঞ্জে বিস্ফোরণের পেছনে ছিল ইসরায়েল। এর এক দিন আগে এই হামলার পেছনে ইসরায়েল কি না জানতে চাইলে ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরোক্ষভাবে স্বীকার করে বলেছেন, ইরানে আমাদের তৎপরতার কথা না বলাই ভালো।

ইসরায়েল সাধারণত এ ধরনের হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে না। ইরানি কর্মকর্তারাও সরাসরি ইসরায়েলকে দায়ী করা থেকে বিরত থেকেছেন। তবে ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে, দুটি দেশের মধ্যে এরই মধ্যে সাইবারযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

তথ্যসূত্র : বিবিসি।

 

আপনার মতামত লিখুন :