আরোগ্য লাভে ২০ বছর ধরে মসজিদ ধুয়ে পানি পান!

প্রকাশিত : ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

লক্ষ্মীপুরে রোগ-বালাইসহ বিভিন্ন সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে মানত করে মসজিদ ধুয়ে পানি পান করেন শতশত নিয়তকারী মানুষ। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে চর মার্টিন ইউনিয়নে ছেরাজ আমিন জামে মসজিদে প্রায় ২০ বছর ধরে এ ঘটনা ঘটে আসছে।খুব ভোরে নারীদের জটলা দেখে যে কেউই ভাবতে পারেন, হয়তো কোন ঘটনা দেখার জন্য উৎসুক জনতার ভীড়। কিন্তু কাছে যেতেই বুঝা যায় সে রকম কিছুই নয়। মূলত জটলার পাশে থাকা আধা-পাকা মসজিদ ঘরটি ধুয়ে দেয়ার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা নারীদের ভীড়। এমন দৃশ্য দেখে সবাই হতবাক।

সংখ্যায় এক জন বা দুজন নয়, শতশত নারী মসজিদ ধোয়ার নিয়ত করে প্রতি শুক্রবার ভোরে ভীড় জমায়। মসজিদ ধোয়া সেই পানি নিয়ে পান করে রোগমুক্তিসহ মনের আশা পূরণের জন্য। গত প্রায় ২০ বছর ধরে চলে আসছে এ কাজ। শুক্রবার ভোরে সরেজমিন গিয়ে এমনই দৃশ্য দেখা গেছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এদিন ফজরের নামাজ শুরুর আগেই বিভিন্ন বয়সী কয়েকজন নারী এসে মসজিদের পাশে পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কথাবার্তায় বুঝা গেলো বহুদূর থেকে ছুটে এসেছেন এখানে। ফজরের নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই মুসল্লিরা মসজিদ থেকে বের হয়ে দ্রুত মসজিদ খালি করে দেয়। পরের দৃশ্যটা আরো অন্যরকম। দাঁড়িয়ে থাকাসহ আরো অনেক নারী জগ ও ছোট কলস হাতে নিয়ে নেমে পড়ে মসজিদ ধোয়ার কাজে। পাশের পুকুর ও নলকূপ থেকে হিসেব করে ৩ জগ কিংবা ৩ কলস পানি নিয়ে এসে ঢেলে দেয় মসজিদের দরজা, বারান্দা এবং মেহেরাবে।

পড়ে মসজিদ ধুয়ে গড়িয়ে পড়া কিছু পানি বোতলে ভরে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। কেউ কেউ ২ রাকাত নামাজও আদায় করেন। অনেককে মসজিদের দরজা, দেয়াল এবং মেহরাব ধরে কাঁদতেও দেখা যায় এসময়। নারীদের পাশাপাশি কয়েকজন যুবককেও দেখা গেছে একই কাজে। এ সময় ছবি ওঠাতে গেলে বাঁধা দেয় কয়েকজন। ভোরে ৩০ কিমি দূরের লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে ছুটে আসা যুবক আশরাফ জানান, তিনি নিজের বোনকে নিয়ে এসেছেন এখানে। বোন কি যেন একটা নিয়ত করেছে।

কমলনগরের হাজিরহাট থেকে ছুটে আসা মধ্য বয়সী নারী জেবুন্নেছা জানান, তিনি মসজিদ ধোয়া কিছু পানি বোতলে ভরে নিয়েছেন। বাড়িতে গিয়ে সেগুলো পান করবেন রোগ মুক্তির আশায়। তরুণ রহমান জানান, মা-বাবার অনুরোধে তিনি মসজিদ ধুয়েছেন এসএসসি পরীক্ষায় পাশের নিয়তে।

মসজিদ এলাকার বাসিন্দা সালেহা বেগম জানান, যারা একবার পানি দিয়ে মসজিদ ধুয়েছে তাদেরকে আসতে হবে পরপর তিন শুক্রবার। তিনি আরো জানান, তরুণী থেকে বৃদ্ধ সকল বয়সের নারীরাই বিভিন্ন নিয়তে এখানে আসছে অন্তত ২০ বছর যাবত। তবে এখন নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও আসা শুরু হয়েছে। বর্তমানে প্রতি শুক্রবার পূর্বের তুলনায় লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে মসজিদ ধোয়া পানি বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন খাওয়ার নিয়তে। অনেকে নিয়ত করে নামাজও পড়ছেন। কেউ কেউ মসজিদের দেয়াল ছুঁয়ে কান্নাকাটি করছেন।

স্থানীয় ভাবে জানা যায়, বহু বছর আগে মেঘনা নদী যখন (আনুমানিক ১৯৫০ সাল) ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বর্তমান লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ এলাকায় পৌঁছে, তখনকার ভবানীগঞ্জ এলাকার স্থানীয় করিম বক্স জামে মসজিদটি নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে। মুসল্লিরা করিম বক্স জামে মসজিদটি খুলে নিয়ে বর্তমান কমলনগর উপজেলার নতুন জেগে ওঠা চর মার্টিন গ্রামের বর্তমান স্থানে নতুনভাবে স্থাপন করে। জেগে ওঠা চরের এ স্থানটি জনৈক ছেরাজ আমিনের দখলে থাকায় স্থানীয়রা নতুন মসজিদকে ছেরাজ আমিন মসজিদ নামে নামকরণ করে। মসজিদটি প্রথমে খড়ের ছাউনি থাকলেও পরে টিনের ছাউনি দেয়া হয়। অন্যান্য মসজিদের ন্যায় সাধারণ মসজিদ ছিল এটি।

গ্রামের শাহে আলম পূর্বের মুরব্বীদের বরাত দিয়ে জানান, তিনি শুনেছেন প্রায় ২০ বছর আগে বর্তমান ইমামের বাবা নাকি স্বপ্ন দেখেন, যেসব নারী শুক্রবার এ মসজিদ ধুয়ে দিবেন, বিনিময়ে তার মনের আশা পূরণসহ রোগ মুক্তি হবে। একথাটি কোন এক নারীর কান হয়ে এখন হাজার হাজার নারীর কানে পৌঁছে গেছে। এখন প্রতি শুক্রবারই শতশত নারী ছুটে আসছেন মনের আশা পূরণের জন্য।

তবে বর্তমান ইমাম মাওলানা জাহের বলেন, ঘটনাটি প্রায় ১৬/১৭ বছর ধরে চলে আসছে সত্য। কিন্তু কিভাবে এটা শুরু হয়েছে তা জানেন না তিনি। তিনি আরো জানান, মহিলাদেরকে এ রকম কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি কিন্তু কেউ তার কথা শুনছে না। তিনি এটাকে বিদআত হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও চর মার্টিন ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মোঃ শাহাব উদ্দিন জানান, বিভিন্ন নিয়ত বা মানত করে রোগ মুক্তির আশায় নারীরা এ কাজ করে যাচ্ছে অনন্ত ২০ বছর যাবত। এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি নারীদের কে বিভিন্ন সময় নিষেধ করেছেন।

নিয়ত মানাত করে মসজিদ ধোয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে, কমলনগরের হাজিরহাট হামেদিয়া ফাজেল মাদরাসার ডিগ্রী মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা যায়েদ হোসেন ফারুকী বলেন, মক্কা, মদিনা এবং বায়তুল মোকাদ্দাসের মতো তিনটি মসজিদ বাদে আল্লাহর কাছে পৃথিবীর সকল মসজিদের গুরুত্বই সমান। সুতরাং কোন একটি বিশেষ মসজিদকে নিয়ত করে ধুয়ে দেয়া বিদআত হবে। তিনি মুসলমানদের এ রকম কাজ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করেন।

এদিকে নিয়ত করে মসজিদ ধোয়াকে ধর্মী কুসংস্কার ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত কাজ আখ্যা দিয়ে তা বন্ধ করতে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে স্থানীয় সচেতন মুসল্লিরা।

আপনার মতামত লিখুন :