সাংবাদিকতার রেনেসাঁ ছিলেন আতাউস সামাদ: ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম

প্রকাশিত : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

কিংবদন্তির সাংবাদিক আলোর প্রত্যাশী আতাউস সামাদের আজ তার অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। আতাউস সামাদ সব সময় সত্যসন্ধানে ছুটে বেড়াতেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি মাঠে ছিলেন। সত্যতা যাচাই করার শিক্ষা তিনি দিয়ে গেছেন। তিনি ছিলেন বস্তুনিষ্ঠতার প্রতীক। সাংবাদিকতার রেনেসাঁ ছিলেন আতাউস সামাদ। সাংবাদিকতার শুরুতে তিনি বাংলা ও ইংরেজি দুটিতে দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি অতিসাধারণ জীবনযাপন করতেন।

বিপন্ন সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করে গণতন্ত্র হত্যার ষড়যন্ত্র নস্যাত্ ও দেশকে বর্তমানের গভীর সঙ্কটের হাত থেকে রক্ষার আন্দোলনে আতাউস সামাদ আমাদের প্রেরণা। তিনি সংগ্রামের পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। স্বৈরাচার, গণবিরোধী সরকারের আমলেও তিনি সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলে গণতন্ত্র এবং জনগণের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আজ আমরা যারা লড়াই করছি, তাদের সাহস জুগিয়েছেন আতাউস সামাদ। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকা। দেশের বিভক্ত সমাজেও তিনি সব বিভক্তির ঊর্ধ্বে ওঠে কথা বলতেন। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আমার দেশ পত্রিকার মাধ্যমে এক ধরনের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পেছনেও তিনি ছিলেন শক্তি। বাংলাদেশে এমন সাহসী মানুষের সংখ্যা খুব কম। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল সত্য প্রকাশ করা।

আতাউস সামাদের লেখায় সমাজের প্রতি ভালোবাসা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল। সাংবাদিকদের মধ্যে মহোত্তম মানুষ ছিলেন আতাউস সামাদ। তিনি ছিলেন আমার পড়ন্ত বেলার শিক্ষক। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ।

আতাউস সামাদ ছিলেন পারফেকশনিস্ট সাংবাদিক। তিনি ছিলেন পরিচ্ছন্ন, সুখী ও সত্ সাংবাদিক। তিনি ছিলেন সততা, নৈতিকতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে। তাঁর মতো সাংবাদিক এখন বিরল। একটি সংবাদ লেখার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি চেষ্টা করতেন, সংবাদের তথ্য, মতামত যেন সঠিক থাকে। সত্য বলে তিনি যা বিবেচনা করতেন, তাই লিখতেন ও বলতেন। আতাউস সামাদ আমাদের অনুকরণীয়। তাঁকে এ প্রজন্মের সাংবাদিকদের অনুসরণ করা উচিত। তাঁর প্রয়াণের পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পক্ষ থেকে কোনো শোক বাণী আসেনি। তাতেই প্রমাণিত হয় এরশাদের সেনাতন্ত্র ও আতাউস সামাদের গণতন্ত্র প্রিয়তা।

আতাউস সামাদ ছিলেন সত্ সাংবাদিকতার পক্ষে আর হলুদ সাংবাদিকতার বিপক্ষে। তিনি সংবাদপত্র শিল্প ও সাংবাদিকদের মধ্যে আইকন হিসেবে বহুকাল বেঁচে থাকবেন। আতাউস সামাদ একাত্তর সালে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, আবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে পালন করেছিলেন বিশাল ভূমিকা। যে ক’জন প্রথিতযশা সাংবাদিকের জন্য সাংবাদিকরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেন, সাংবাদিকরা অহঙ্কার করতে পারেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আতাউস সামাদ। তিনি সাংবাদিকতা করার পাশাপাশি সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করে গেছেন।

বরেণ্য সাংবাদিক আতাউস সামাদ নিরপেক্ষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন মানুষের পক্ষে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় তিনি এ দেশের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রথম পরিচয় থেকে তার মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত দেখেছি, তিনি ছিলেন সৎ। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথিকৃত ছিলেন। আবেগ দ্বারা তাড়িত হতেন না। ঘটনার ভেতরের ঘটনা বের করে আনতে পারতেন। আমি ছিলাম তাঁর অনুরাগী ও ভক্ত।

মাথা থেকে পা পর্যন্ত সৎ মানুষ ছিলেন আতাউস সামাদ। অনুসন্ধানী ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় আতাউস সামাদের জুড়ি ছিল না। তাঁর কোনো প্রতিবেদন নিয়ে বিতর্ক হয়নি, তিনি জীবনভর সুনাম বজায় রেখে সাংবাদিকতা করেছেন।

সাংবাদিক আতাউস সামাদ স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যেমন সোচ্চার ছিলেন তেমনি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য কখনও আপোস করতেন না।

আতাউস সামাদ যেভাবে প্রতিবেদন তৈরি করতেন তা সত্যিই অনুকরণীয়। স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কারণে তাঁকে জেলও খাটতে হয়েছে। আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আতাউস সামাদের খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। তিনি সব সময় দেশ ও মানুষের কথা ভাবতেন। এজন্য তাঁর সাংবাদিকতা, প্রতিবেদন তৈরি ও কাজে দেশপ্রেম ফুটে উঠত। সব সময় সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাছাড়া সাংবাদিকতা মানেই প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু তিনি নিজেকে কখনও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আটকে রাখতে চাননি। সব কিছুর পরেও সঠিক কাজটি করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন তিনি।

আতাউস সামাদ সাংবাদিকতার শিক্ষক ছিলেন l তাঁর অকুতোভয় ও সাহসী লেখনী বাংলাদেশের মানুষ সারাজীবন মনে রাখবে।

আতাউস সামাদ ১৯৩৭ সালের ১৬ নভেম্বর ময়মনসিংহে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিলাভের পর ১৯৫৯ সালে সাংবাদিকতা শুরু করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম কামরুন্নাহার রেনু। তিনি দীর্ঘদিন প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশে (পিআইবি) কর্মরত ছিলেন। তিনি এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।

১৯৫৯ সালে সাংবাদিকতা শুরু করেন আতাউস সামাদ। ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টের (ইপিইউজে) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান অবজারভারের চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। এ ছাড়া তিনি ১৯৮২ সাল থেকে টানা ১২ বছর বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস নিউজের বাংলাদেশ সংবাদদাতা ছিলেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি সাপ্তাহিক এখন এর সম্পাদক ছিলেন। বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির নির্বাহী প্রধান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি আতাউস সামাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন।

জীবন, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির গতি-প্রকৃতি অবলোকন করেছেন তার নিজস্ব চিন্তায় আর বাস্তবতার আলোকে। তার এ চিন্তা তিনি প্রকাশ করেছেন কলামের মাধ্যমে। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। জানা যায়, সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তিনি মানবতা রক্ষা ও যে কোনো প্রগতিশীল আন্দোলনের পক্ষে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। তার সৎ, সাহসী ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার কারণেই জাতি তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
আতাউস সামাদ এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জেলে যাওয়ারও ঝুঁকি নিয়েছিলেন, জেলেও গিয়েছিলেন। তিনি সবসময়ই নিউজের সোর্সকে অসামান্য প্রাধান্য দিতেন।

সাংবাদিক আতাউস সামাদ ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন।

কর্মজীবনে তিনি পাকিস্তান অবজারভার ও বাংলাদেশ অবজারভার, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস), বিবিসিসহ দেশের ও দেশের বাইরের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৯২ সালে একুশে পদক পান।

৮০ এবং ৯০-এর দশকে বাংলাদেশে বিবিসি বলতে মার্ক টালির নামের পাশে যে নাম উচ্চারিত হতো সেই নাম হচ্ছে আতাউস সামাদ I মিঃ সামাদ দীর্ঘ ১২ বছর ঢাকায় বিবিসি নিউজের সংবাদদাতা ছিলেন, অনেক ঘটনা দেখেছেন, কাভার করেছেন, যেমন, এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময় বিবিসি বাংলার খবর ছিলো এক ধরনের লাইফ-লাইনের মত যেখানে প্রধান তথ্য সরবারহকারী ছিলেন আতাউস সামাদ I তিনি আশির দশকে যখন বিবিসিতে যোগ দেন তখন দেশে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার এত জয়জয়কার ছিল না। গ্রামের আপামর জনগণের তখন সংবাদ শোনার মাধ্যম ছিল রেডিও। সে সুবাদে বিবিসি বললেই সাধারণ মানুষ আতাউস সামাদকে বুঝতেন। এখনো গ্রাম-বাংলার মানুষের মুখে মুখে আতাউস সামাদের নাম ঘুরেফিরেই উচ্চারিত হয়।
একজন সাংবাদিক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে দেশ জাতির কল্যাণে নিজেকে নিযুক্ত করেন। আতাউস সামাদ সে কাজটিই করতেন দক্ষতার সঙ্গে। যে কারণে সাংবাদিক সমাজেও তার রয়েছে আলাদা সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা। তিনি দেশের চলমান রাজনীতি বিশ্লেষণ করে কলাম লিখতেন। তিনি সূচিন্তিত ও বিশ্লেষণধর্মী কলামের মাধ্যমে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিতেন। সরকারের সমালোচনা যেমন করতেন তেমনি সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথও বাৎলে দিতেন। দেশ ও সমাজ নিয়ে তার গভীর পর্যবেক্ষণ তিনি লেখনীতে ফুটিয়ে তুলতেন। এক কথায় তিনি ছিলেন দেশের সম্পদ। আমরা মনে করি, বাংলাদেশে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার যে ধারা আতাউস সামাদ সৃষ্টি করেছেন তা অনুসরণযোগ্য। বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশে তাকে অনুসরণ করে জাতিকে যে কোনো বৃহত্তর সঙ্কট মোকাবেলায় দিকনির্দেশনা দিতে সচেষ্ট হবেন।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন চলাকালে বিবিসিতে আতাউস সামাদের কণ্ঠ শোনার জন্য পুরো জাতি উদগ্রীব থাকত। রাষ্ট্রের বর্তমান দুঃসময় ও নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি নিয়ে লেখার জন্য আতাউস সামাদকে আমাদের দরকার ছিল। কর্ম ও পেশাগত জীবনে আতাউস সামাদ ছিলেন একজন সত্ মানুষ। জীবনের সব কাজে তাঁর সততার প্রতিফলন ঘটেছে।

এখনকার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সাংবাদিকদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। আতাউস সামাদকে অনুসরণ করে সাংবাদিকদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে।

লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, কলামিষ্ট, সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ

আপনার মতামত লিখুন :