সাড়া ফেলেছে ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি বাংলা মডেল’

প্রকাশিত : ২৬ অক্টোবর ২০২১

এ যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বহুমুখী ব্যবহার। প্রতিষ্ঠানের মাঠের চারদিকে বেড়ে উঠেছে বাহারি জাতের সবজি ও ফলের গাছ। কোনোটি ফলন্ত আবার কোনোটি ফল-ফসল দেওয়ার উপযোগী হয়ে উঠেছে। এগুলো চাষ ও পরিচর্যা করেছে প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষার্থীরা। পাবনার বেড়া উপজেলার কাশীনাথপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ মাঠে এমনই নয়ন মনোহর দৃশ্য।
এ দৃশ্যের অবতারণা করেছেন কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি এবং শিক্ষাবিদ ড. মো. আমিন উদ্দিন মৃধা। তিনি ‘একজন শিক্ষার্থী একটি সমন্বিত কৃষি খামার’ নামের একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে এ গবেষণা কর্মটি বাস্তবায়ন করছেন। পাইলট প্রকল্পটি সফল হওয়ায় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। বিদেশের অনেক বিশেষজ্ঞও এ ধারণাটি সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

গবেষক ড. মো. আমিন উদ্দিন মৃধা এখন ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি বাংলা মডেল’ নামে এটিকে সারাদেশের সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছেন। এতে কৃষিতে যুগান্তকারী সাফল্য আসবে বলে তিনি দাবি করেন।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও কিং সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. আমিন উদ্দিন মৃধা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘একটি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’ কথাটি তার মনে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করে। তিনি চিন্তা করেন দেশের অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠের চারপাশ অব্যবহৃত থেকে যায়। এছাড়া শিক্ষার্থীদের অনেক সময় অবসর থাকে। পাঠের মাঝে তাদের মানসিক শান্তি দিতে বা সৃজনশীল কিছু করাতে পারলে তাদের দেহ-মন দুটোই ভালো থাকবে।

তিনি ভাবনায় আনেন প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীকে। এত শিক্ষার্থী আর দেশের সর্বস্তরের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠের অব্যবহৃত জায়গাকে তিনি কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেন। এতে দেশের টেকসই কৃষিক্ষেত্র প্রস্তুত ও জলবায়ু বিপর্যয় রোধেও কাজ করবে। কর্মসূচিটি অবিচ্ছিন্নভাবে বছরের পর বছর চলবে। তাজা, স্বাস্থ্যকর এবং দূষণমুক্ত ফল সবজি আহরণ হবে। দেশের মানুষই এর সুফলভোগী হবে।

বাংলাদেশ কৃষি একাডেমির ফেলো এবং ন্যানো প্রযুক্তি গবেষণাক্ষেত্রে অনন্য অবদান রাখা ড. আমিন উদ্দিন মৃধা জানান, তিনি দেশের জমিকে সর্বোচ্চ ব্যবহারের কৌশল প্রয়োগের জন্য গবেষণা শুরু করেন। পাবনার বেড়া উপজেলার কাশীনাথপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজে গত বছর ‘একজন শিক্ষার্থী একটি সমন্বিত কৃষি খামার’ নাম দিয়ে পাইলট প্রজেক্ট শুরু করেন।

তিনি জানান, কলেজ মাঠের অখণ্ডতা ঠিক রেখে মাঠের চারদিকে শাক সবজি ও ফল চাষ করার উদ্যোগ নেন। শিক্ষার্থীদের বিরতির সময়কে কাজে লাগান। সম্মিলিতভাবে এ কাজে কম সময় লাগে। তার পাইলট প্রজেক্টে নানা রকম শাক-সবজি ফলেছে। এরই মধ্যে একবার বিষমুক্ত শাক-সবজি তোলা হয়েছে।নতুন করে শাক-সবজি লাগানো হয়েছে আবার কিছু গাছ এখন ফলন্ত। কিছু ফল গাছ থেকে আগামী বছরই ফল পাওয়া যাবে।

বর্তমানে চীনের গুইঝো বিশ্ববিদ্যালয় এবং থাইল্যান্ডের মাই ফাহ লুয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণায় থাকা কৃষি বিজ্ঞানী ড. আমিন উদ্দিন মৃধা জানান, তিনি এ পাইলট প্রজেক্ট-এ সফল হয়েছেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে গত জুন মাসে তিনি শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপুমনির সঙ্গে বৈঠক করে পাইলট প্রজেক্ট ও তার ধারণা উপস্থাপন করেছেন। ফলপ্রসূ সেই বৈঠকে তিনি মন্ত্রীর সহযোগিতা লাভ করেন। এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতর থেকে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য একটি পত্রও ইস্যু করা হয়েছে।

ড. আমিন উদ্দিন মৃধা জানান, তার প্রস্তাবিত প্রকল্পে সরকারিভাবে কোনো বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজন নেই। এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতেও এ মডেল বাস্তবায়নে কোনো অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন নেই। শাক-সবজির সামান্য বীজ ও শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের বাড়ি থেকে আনা ফলজ বা গাছের চারা আনলেই হয়ে যাবে।

বাস্তবায়ন পদ্ধতি সম্বন্ধে তিনি জানান, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী, কৃষি গবেষণা সংস্থা এবং এনজিও সংস্থা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। উপজেলা কৃষি অফিসের মাঠ কর্মীরা দেশের গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড পর্যন্ত কর্মরত। তারা সপ্তাহে বা দু’সপ্তাহে এলাকা পরিদর্শনের সময় স্কুলগুলোর সবজি-ফল বাগান ঘুরে দেখে পরামর্শ দিয়ে যেতে পারবেন। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কাজ-কর্ম অনুসরণ করে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক মূল্যায়নকে সংযুক্ত করে তাদের পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন করতে পারবেন। শিক্ষার্থীদের এ কাজ তাদের নিজ বাড়িতেও চর্চা করতে উৎসাহিত করবে। তারা কর্মজীবনে গিয়ে এর সুফল পেতে থাকবে।

কী ধরনের সবজি বা ফল চাষ হতে পারে- এ প্রশ্নের জবাবে ড. মৃধা জানান, বিভিন্ন ধরনের হর্টিকালচারাল ফসল বা হলুদ, আদা এবং অন্যান্য ছায়াময়ী গাছপালাও চাষ করা যেতে পারে। হরেক রকম শাকসবজি উৎপাদন করা যেতে পারে। ফল ও কাঠের গাছ লাগানো যেতে পারে।

তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রাস্তার পাশে এবং রেললাইনের কাছেও অনুশীলন করা যেতে পারে। শিক্ষার্থী ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সহযোগিতায় হাজার হাজার মসজিদ এবং অন্যান্য প্রার্থনা স্থানের ছাদকে ফল গাছের ছাদ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে।

ড. মৃধা জানান, বাংলাদেশের টেকসই কৃষিক্ষেত্র ও জলবায়ু পরিবর্তন নিরসনের জন্য শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে সজনে চাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের কৃষির পাশাপাশি, প্রতিটি স্তরের শিক্ষার্থীদের দ্বারা প্রতিটি ঘরে সজনে চাষ করা যেতে পারে। সজনের বিশাল ঔষধি গুরুত্ব রয়েছে। এটি মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। সজনে গাছ পানি পরিশোধক, সবুজ সার, মাইকোট্রফিক উদ্ভিদ, বনজ পুনরুদ্ধার, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ, পশুর খাবার ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা হয়। শিক্ষার্থীদের কাজে লাগিয়ে প্রতিটি ঘরে ১টি বা ২টি সজনে গাছ রোপণ করা গেলে দেশে কমপক্ষে ৩-৬ মিলিয়ন সজনে গাছ থাকবে।

ড. আমিন উদ্দিন মৃধা জানান, তার পাইলট প্রকল্পস্থল কাশীনাথপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকেই শিক্ষার্থীদের মাঝে চলতি বর্ষাকালীন সময় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রচুর পরিমাণে সজনে ডাল বিতরণ করতে পেরেছেন। তিনি আশা করেন আগামীতে হাজার হাজার চারা এবং ডাল বিতরণের সক্ষমতা আসবে। এতে এক বা দুই বছরের মধ্যে এ এলাকায় প্রচুর সংখ্যক সজনে গাছ থাকবে।

ড. মৃধা জানান, বজ্রপাতের হাত থেকে সুরক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিরসনের জন্য শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে তালগাছ রোপণের একটি সম্ভাবনাময় ধারণা তিনি তার প্রকল্পে রেখেছেন। বজ্রপাতজনিত মৃত্যু বৃদ্ধির মূল কারণের মধ্যে তালগাছ এবং খেজুর গাছের ঘাটতি অন্যতম। তালগাছ বজ্রপাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করে। তিনি জানান, তালগাছ রোপণ করতে শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, কৃষক এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তা নেয়া গেলে লাখ লাখ তালগাছ হবে। ‘কৃষকের ছাউনি’ হতে পারে তালগাছ। তার পরীক্ষামূলক কর্মসূচির আওতায় এসসিআরআই থেকে প্রাপ্ত ৪০-৫০ হাজার তালের চারা বিতরণ করতে পেরেছেন।

ড. মৃধা জানান, তার প্রস্তাবিত প্রোগ্রামে ভার্মি কম্পোস্ট প্রযুক্তি, জৈব সার এবং আরো অনেক উদ্ভাবনী প্রযুক্তি শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে প্রয়োগ করা যেতে পারে। চাষের জৈবিক পদ্ধতি অনুসরণের মাঝে (যা সবুজ চাষ) তারা বিপজ্জনক রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ছাড়াই বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ফলাবে। প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের জন্য কর্তৃপক্ষের পরিচালনায় মৌসুমী শাকসবজি এবং অন্যান্য ফসলের চাষের জন্য নিজস্ব খালি জমি ব্যবহার করতে পারে। প্রথমে সব শিক্ষক তাদের নিজস্ব বাসভবনে অনুশীলন অনুসরণ করবেন এবং কমপক্ষে ১০ জন শিক্ষার্থীকে অনুশীলন করার প্রশিক্ষণ দেবেন।

ড. আমিন উদ্দিন মৃধা জানান, শুরুতে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি পাইলট প্রোগ্রাম নেয়া যেতে পারে। প্রথমত, ৮টি বিভাগ থেকে কমপক্ষে ২০টি মহিলা কলেজে প্রোগ্রামটি চালু করার জন্য নির্বাচিত হতে পারে। এরপর ধাপে ধাপে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালু করা যেতে পারে। পাবনার বেড়া উপজেলার কাশীনাথপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ মাঠে ড. আমিন উদ্দিন মৃধার পাইলট প্রজেক্টটি এরই মধ্যে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। পুরো কলেজে যেন এখন সবুজের মেলা। কলেজের ছাদ থেকে শুরু করে বারান্দা বা অফিস কক্ষ সব জায়গাই নানা জাতের গাছ দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো। কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানান।

দুলাই সরকারি কলেজের প্রভাষক সালাউদ্দিন আহমেদ জানান, একজন শিক্ষার্থী তার লেজার টাইমে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছে। এতে সবজি বা ফল চাষের প্রতি তার একটা অভিজ্ঞতা ও হৃদ্যতা তৈরি হচ্ছে। এর চর্চা তার বাড়ির আঙিনায় বা ছাদে হবে। এটি তার সংসার জীবনেও কাজে লাগবে। আমিনপুর থানার কদিমালি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাফিজুর রহমান জানান, এটি একটি অনন্য মডেল। পাইলট প্রকল্পটি সফল হওয়ার পর ড. আমিন উদ্দিন মৃধা এর নামকরণ করেছেন ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি বাংলা মডেল।’ এ মডেল সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালু হলে একটি নিরব সবজি বা ফল বিপ্লব হবে।

কাশীনাথপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের বেশ কিছু শিক্ষার্থী তাদের আনন্দের কথা জানান। তারা এখন সবজি বা ফল বাাগানে শুধু দেখভালই করেন না, এতে মানসিক প্রশান্তিও লাভ করেন। দ্বাদশ শ্রেণির মহিমা খাতুন ও ইসরাত জাহান বন্যা জানান, তারা কলেজে সবজি ও ফল গাছের যত্ন পরিচর্যা করেন। করোনাকালে কলেজে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে এসেও তারা বাগান ঘুরে দেখতে ভুল করেননি। এতে তাদের ভাল লাগা তৈরি হওয়ায় নিজ বাড়িতেও তারা এখন সবজি ও ফল চাষ করছেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমন্বয় করা শিক্ষক আসাদুজ্জামান খান জানান, তিনি আনন্দের সাথে মৃধ্যা স্যারের উদ্ভাবিত পাইলট প্রকল্পে কাজ করছেন। পাইলট প্রকল্পটি সফল হওয়ায় তিনি আনন্দিত।

কাশীনাথপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রোকসানা খানম জানান, পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে ধারণাটি সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত হলে এ মডেল পরিপূর্ণতা লাভ করবে। তার কলেজে পাইলট প্রজেক্টটি শুরু হওয়ায় কলেজটি গবেষণার সূতিকাগার হতে পেরেছে। এটি একটি গৌরবের ব্যাপার। তিনি আরো জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষকদের সবচেয়ে বেশি সম্মান করতেন। সে হিসেবে এ প্রকল্পর নামকরণ ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি বাংলা মডেল’ সার্থক হয়েছে।

আপনার মতামত লিখুন :