ওমিক্রন আতঙ্ক শঙ্কায় ভারত ভয়ংকর সংক্রমণের

প্রকাশিত : ৩ জানুয়ারি ২০২২

মহামারি করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবায় সৃষ্ট সংকটময় পরিস্থিতির মাঝেই বিশ্বজুড়ে নতুন আতঙ্ক তৈরি করেছে গত নভেম্বরের শেষের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হওয়া প্রাণঘাতী ভাইরাসটির অতি সংক্রামক ধরন ওমিক্রন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্রমশ লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে; বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে ওমিক্রনের ব্যাপকভাবে আধিপত্য বিস্তার করে চলছে। দক্ষিণ এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ দেশ ভারতেও ভ্যারিয়েন্টটির সংক্রমণ ব্যাপক বিপজ্জনক পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলে দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক বিশেষ বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।

এনডিটিভির মেহের পাণ্ডে এবং সৌরভ গুপ্ত দেশটিতে বর্তমান সংক্রমণের বিশেষ তথ্য বিশ্লেষণের পর বলেছেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের দাপটে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতে প্রত্যেক দিন গড়ে ৬০ হাজারের মতো মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

দেশটির সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভারতে মোট কোভিড রোগীর মধ্যে ২ শতাংশেরও কম বর্তমানে ওমিক্রনে শনাক্ত। যদিও এনডিটিভির গবেষণা বলছে, প্রকৃত চিত্র আসলে এর চাইতে ভয়াবহ। ভারতে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট আধিপত্যশীল হয়ে ওঠায় শিগগিরই দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সংকট তৈরি হতে পারে বলে এরই মধ্যে সতর্ক করে দিয়েছেন মেহের পাণ্ডে এবং সৌরভ গুপ্ত।

ভারতের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যে দেশটিতে বর্তমানে ওমিক্রনে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার বলে ধারণা করা হলেও প্রকৃত সংখ্যা তার চাইতে ১০ গুণেরও অধিক। অর্থাৎ এই মুহূর্তে ভারতে ১৮ হাজার মানুষ ওমিক্রনে সংক্রমিত হয়েছেন এবং প্রত্যেক দিন সেই সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের পথে হাঁটছে ভারতও; অনেক দেশে বর্তমানে যারা নতুন করে করোনায় সংক্রমিত হচ্ছেন তাদের প্রায় ৯০ শতাংশই ওমিক্রনে শনাক্ত। ভ্যারিয়েন্টটিতে সংক্রমিত হওয়ার জন্য অপরিহার্য জিনোম সিকোয়েন্সিং ব্যবস্থা, পরীক্ষাগার ও ল্যাবরেটরির সংখ্যা কম হওয়ায় ভারতে ওমিক্রন রোগীর সরকারি চিত্র এখনো অনেক কম। যদিও ওমিক্রন শনাক্ত করতে সক্ষম এমন দুটি ল্যাবের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে এনডিটিভি। সেই তথ্য বিশ্লেষণে পাওয়া ওমিক্রন রোগীর সংখ্যা সরকারিভাবে ঘোষিত সংখ্যার ভিন্ন গল্প বলছে।

প্রধান দুটি ল্যাব যার একটি দিল্লি এবং অপরটি মুম্বাইয়ে ওমিক্রন পরীক্ষা করে। তাদের পরীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, করোনা আক্রান্ত সব রোগীর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশের নমুনায় ওমিক্রন পাওয়া গেছে। দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের অপর একটি ল্যাবের তথ্যও একই ধরনের কথা বলছে। সেই ল্যাবে করোনা পজিটিভ রোগীদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশের নমুনায় ওমিক্রন পাওয়া গেছে। এক সপ্তাহ আগেও সেখানে এই হার ছিল সর্বোচ্চ ৩৭ শতাংশ।

এনডিটিভির প্রতিবেদক বলছেন, বিশেষ উদ্বেগজনক সত্য হলো ওমিক্রন সংক্রমণ ডেল্টার তুলনায় অনেক দ্রুত বাড়ছে। দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে মোট কোভিড রোগীর প্রায় ২ শতাংশের ওমিক্রন ছিল; তারপর কয়েক দিন আগে সেটি ৩০ শতাংশ হলেও এখন তা ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। নির্ধারিত এই সময়ের মধ্যে শক্তিশালী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। এমনকি ওমিক্রন ভারতে আধিপত্য বিস্তারকারী ভ্যারিয়েন্টে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু এই সংবাদ ভারতের জন্য একদিক থেকে ভালো মনে হলেও অন্যদিক থেকে খারাপ। সুসংবাদ হলো ডেল্টার তুলনায় ওমিক্রন কম গুরুতর অসুস্থতা তৈরি করে। কেননা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত উচ্চ সংখ্যক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় এবং ওমিক্রনের তুলনায় ডেল্টায় মৃত্যুর হারও অধিক।

যদিও ভারতের জন্য উদ্বেগজনক খবর হলো, ওমিক্রন ডেল্টার চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন এই ধরন ডেল্টার চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি সংক্রামক বলে ধারণা করা হচ্ছে। সুতরাং এটি এমন এক ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সারা বিশ্বের মতো ভারতেও যদি করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ে, তাহলে দেশটি সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছালে প্রত্যেক দিন ১৬ থেকে ২০ লাখ পর্যন্ত মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হতে পারেন। দেশটিতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ডেল্টা সংক্রমণের সর্বোচ্চ চূড়ায় যে সংখ্যা ছিল চার লাখ।

এনডিটিভি বলছে, সংকটময় এমন পরিস্থিতি ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণহীন চাপ তৈরি করবে। হাসপাতালের শয্যা, অক্সিজেন সিলিন্ডার, চিকিৎসক এবং ওষুধ প্রাপ্তির মতো সংকট দেখা দেবে। ওমিক্রনে সংক্রমিতদের মধ্যে কয়েক শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হলেও মোট রোগী এবং সংক্রমণের সংখ্যা অনেক বেশি হবে।

ভারতীয় মিডিয়ার গবেষণায় বলা হয়, ডেল্টায় আক্রান্ত ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ছয়জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। যদিও ওমিক্রনের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা ডেল্টার তুলনায় অর্ধেক। অর্থাৎ ওমিক্রনে আক্রান্ত ১০০ জনের মধ্যে তিনজনকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়।

ওমিক্রন এবং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে ভর্তির এই তথ্য অনুযায়ী, ভারতে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ চূড়ায় পৌঁছানোর সময় দৈনিক সর্বোচ্চ চার লাখ মানুষ ডেল্টায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে শতকরা হিসেবে দৈনিক প্রায় ২৪ হাজার মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। যদিও সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে তৃতীয় ঢেউ চূড়ায় পৌঁছালে দেশটিতে দৈনিক ওমিক্রন রোগী পাওয়া যাবে ২০ লাখ। শতকরা হিসেবে ওমিক্রন আক্রান্ত এই রোগীদের মধ্যে দৈনিক প্রায় ৬০ হাজার মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

ডেল্টা-চালিত দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। ওমিক্রনে আক্রান্ত ৩ শতাংশ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হলেও ভারত বড় ধরনের স্বাস্থ্য সংকটের মুখে পড়তে পারে। কিন্তু ভারত একটি ইতিবাচক আশা করতে পারে যে, ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব ডেল্টার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ হলেও বেশিদিন স্থায়ী নাও হতে পারে।

কেননা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, ওমিক্রন সংক্রমণের ঢেউ ডেল্টার চেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং দ্রুতই শেষ হয়ে যায়।

সূত্র : এনডিটিভি

আপনার মতামত লিখুন :