প্রগতিশীল কৃষক সংগ্রাম পরিষদ: নামক কৃষক জোটের আত্মপ্রকাশ

প্রকাশিত : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২

রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদের সেমিনার কক্ষে ১৯ ফেরুয়ারী শনিবার, সকাল ১০:৩০ ঘটিকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশের ১৫ কৃষক-খেতমজুর-ভূমিহীন সংগঠনের এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ভুমিহীন সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুবল সরকার, পরিচালনা করেন বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনর সভাপতি বদরুল আলম ও লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ চাষী সমিতির সভাপতি সুলতান আহমেদ বিশ্বাস।
সম্মেলনে দেশের কৃষক সমাজের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কৃষকের স্বার্থে দাবী আদায়ের জোট হিসাবে একটি “প্রগতিশীল কৃষক সংগ্রাম পরিষদ” আত্মপ্রকাশ করে। এই পরিষদ কৃষক সমাজের ন্যায় সঙ্গত দাবী নিয়ে মাঠের আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।

সম্মেলনে বাংলাদেশ ভুমিহীন সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুবল সরকারকে আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি বদরুল আলমকে সদস্য সচিব করে গঠিত ৪১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়।

সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আব্দুল মজিদ মল্লিক–বাংলাদেশ ভুমিহীন সমিতি, কামরুজ্জামান ফসি-জাতীয় কৃষক জোট, সুলতান আহমেদ বিশ্বাস- বাংলাদেশ চাষী সমিতি, জায়েদ ইকবাল খান-বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন ,ফয়েজ হোসেন-বাংলাদেশ কৃষক সভা, আলী হাজারী- বাংলাদেশ ভুমিহীন সমিতি, জাকির হোসেন –বাংলদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন , মোঃ নুরুল আমিন কাওসার-জাতীয় কৃষক জোট, অধ্যাক্ষ আশেক ই এলাহী- জাতীয় কৃষক জোট, তারিক মোঃ সাইফুল ইসলাম লিটন-বাংলাদেশ জাতীয় কৃষক সমিতি , রেহানা বেগম-বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন, মোঃ হাসিনুর রহমান- বাংলাদেশ কৃষক সভা, মোঃ ইউসুফ আলী- বাংলাদেশ ভূমিহীন সমিতি, শামীম আরা – বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক ফেদারেশন, বাংলাদেশ সামসুন্নাহার খান ডলি-বাংলাদেশ কিষাণী সভা , অমলি কিস্কু-বাংলাদেশ আদিবাসী সমিতি, শিবলী আনোয়ার-সমগ্র বাংলা কৃষক সমিতি , এমএন মোস্তফা-বাংলাদেশ ভূমিহীন সমিতি, সোলেমান চৌধুরী-সোনার বাংলা কৃষক কেন্দ্র, আম্বিয়া খাতুন শিলা-বাংলাদেশ কিষাণী সভ, পিংকি-বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন, বাংলাদেশ সংযুক্ত কৃষক ও খেতমজুর সমিতি- মোঃ বাব্লু, সামসুল আলম জুলফিকার – শ্রমজীবী আন্দোলন , হারুন অর রশিদ-বাংলাদেশ সংযুক্ত কৃষক ও খেতমজুর সমিতি, ডাক্তার শামসুল আলম-বাংলাদেশ ভুমিহীন সমিতি সৈয়দ হারুন অর রশিদ-সোনার বাংলা কৃষক কেন্দ্র, সুলতানা নাসরিন-বাংলাদেশ কিষাণী সভা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য নিম্নরূপঃ
আপনারা বিশেষভাবে অবগত আছেন যে, এ ভূখণ্ডে ইতিপূর্বে কৃষকদের ন্যায্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে বহুবার কৃষক আন্দোলন-বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছে। উল্লেখ্য সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, টঙ্ক বিদ্রোহ, নানকার বিদ্রোহ, কানসার্ট বিদ্যুৎ আন্দোলন ও দশমিনার খাসভুমি আন্দোলন, পাবনা ঘুঘুদহ বিলের ভুমি আন্দোলনসহ অন্যান্য। তারই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রাথমিকভাবে ১৫টি কৃষক সংগঠন মিলে আমরা “প্রগতিশীল কৃষক সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করেছি।
এক কঠিন সময়ে আমরা এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছি যখন বিগত দু’বছর ধরে সারা বিশ্ব আতংকগ্রস্থতার মধ্য দিয়ে অতিমারী কোভিড -১৯ মোকাবেলা করছে। আমাদের দেশের জনগণও এ কোভিডের অভিঘাতে বিপর্যস্ত- বিপন্নগ্রস্ত। বিশেষ করে শ্রমিক-কৃষক- মেহনতি মানুষের অবর্ণনীয় আর্থিক ও জীবনের ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সরকারের পুনঃপুন লকডাউন ঘোষণা করে কোভিড বিস্তার রোধে ব্যবস্থা নিলেও প্রকৃতপক্ষে অসহায় শ্রমনির্ভর নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জীবন জীবিকার হুমকীর সম্মুখীন হয়েছে।

গ্রামীণ তরুন জনগোষ্ঠীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিশেষ করে নারীরা শহরের শ্রমঘন গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত। কোভিড-১৯ শুরুর প্রথম ধাক্কা মূলতঃ এ শিল্পের উপর পড়েছে। ফলে গার্মেন্টস মালিকরা তাদের হীনস্বার্থে শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার কথা বিবেচনা না করে, তাদের বেতনাদি পরিশোধের চিন্তা না করে গার্মেন্টসসমূহ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে কর্মহীন লক্ষ লক্ষ মানুষ বাধ্য হয়ে গ্রামে চলে যায় ও গ্রামীণ জীবন ও অর্থনীতিতে এক আকস্মিক চাপ সৃষ্টি হয়। তথাপি আমাদের কৃষির বিশালত্ব এদের ধারন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রকারন্তরে আমাদের কৃষি এতটাই সাফল্যের মুখ দেখিছে যা সামগ্রিকভাবে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে কোভিডের ক্ষতিকর প্রভাবকে বৃহদাংশে প্রশমিত করতে পেরেছে। এ বিরাট সাফল্যের কেন্দ্রে রয়েছে দেশের গর্বিত কৃষক সমাজ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সত্য হচ্ছে কৃষকরা এর কৃতিত্বের অংশীদার কখনই হয় না। প্রদীপের নীচে যেমন অন্ধকার থাকে তেমনই কৃষক সর্বদা আড়ালেই থেকে যায়। যে কৃষকরা উৎপাদনে গৌরবময় ভুমিকা রাখে তার সন্তানেরাই পেটপুরে খেতে পায় না, শিক্ষা হতে বঞ্চিত, আশ্রয়হীন ও রিক্ত হস্ত। ফসল ফলিয়েও সে তার জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে পারে না। এর পিছনে রয়েছে এক চিহ্নিত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগী যারা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ধরে বহাল তবিয়তে আছে। বরং তা ডালপালা ছড়িয়ে আরও শক্ত অবস্থান নিয়েছে। শোষণ – বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সোনার হরিণই রয়ে গেল।

কৃষক সমাজের আজকের নাজুক পরিস্থিতি কোনভাবেই তার দুর্বলতা নির্দেশ করে না। আমাদের কৃষকের রয়েছে সুদীর্ঘ আপোষহীন লড়াই সংগ্রামের গৌরবময় ঐতিহ্য। সেই কৃষকের রক্তই আমাদের ধমনীতে প্রবাহমান। সুতারাং কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় আমারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ।

সামগ্রীকভাবে দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ দেশীয় কৃষি পণ্যের প্রতি আগ্রহী ও নির্ভরশীল। অথচ কৃষির প্রতি গুরুত্বহীনতা, মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট ও আমদানীকারকদের চক্রান্তের ফলশ্রুতিতে দেশ কৃষিতে পিছিয়ে পড়েছে । যার প্রেক্ষিতে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে চরম মাত্রায়। দেশ আজও কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে বহুলাংশে আমদানী নির্ভরই রয়েছে। ফলে কতিপয় নিত্য প্রয়োজনীয় কৃষি দ্রব্যের দাম আজ ঊর্ধ্বগামী। কৃষক – শ্রমিক – নিম্ন মধ্যবিত্ত – মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রয় ক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। এ পরিস্থিতি পরিবর্তনের একমাত্র পথ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও টিকসই কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন। এ দেশ কৃষি প্রধান দেশ। দেশ বাঁচাতে হলে কৃষক ও কৃষিকে বাঁচাতেই হবে। এ মর্ম উপলব্ধির প্রেক্ষাপটে আমারা নিম্নোক্ত দাবীনামা আপনাদের মাধ্যমে সরকারের নিকট পেশ করছি –

দাবিসমূহঃ
১।ক)কৃষকের উৎপাদিত ফসলের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করে সকল ধরনের মধ্যস্বত্বভোগীদের উচ্ছেদ কর ;
খ)দানাদার ফসল, সব্জি জাতীয় ফসল, তেল জাতীয় ফসল, ডাল জাতীয় ফসল, মসলা জাতীয় ফসল ও আলুসহ কৃষি পণ্যের লাভজনক মুল্য নিশ্চিত কর ;
গ) কৃষি ফসল সংরক্ষণে পর্যাপ্ত , সাইলো, গুদাম ও কোল্ড স্টোরেজ তৈরী কর ;
ঘ) ভোজ্য তেল, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবের দাম কমাও ;
২। সার, বীজ, সেচের পানিসহ সকল কৃষি উপকরণ (যন্ত্রাদি) বিনামূল্যে
কৃষকদের মধ্য বিতরণ কর ;
৩। ক) প্রকৃত ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে খাসজমি বণ্টন কর ও অবৈধ দখলদারদের খাসজমি হতে উচ্ছেদ কর ;
খ) প্রকৃত জেলেদের মাঝে খাস ও পতিত জলমহাল ইজারা (লিজ) দাও ও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কর ;
৪। ষাট (৬০) উর্ধ্ব সকল কৃষকদের জন্য সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী মতো পেনশন চালু কর ;
৫। ক) খেতমজুর ও ভূমিহীনদের বছরে ১৫০ দিনের কাজের নিশ্চয়তা প্রদান কর ;
খ) কাবিখা, টাবিখা, বয়স্ক ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ, দুস্থ ভাতার পরিমান ও সুবিধাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি কর এবং এর সাথে জড়িত দুর্নীতি দূর কর ;
গ) সর্বজনীন রেশনিং প্রথা চালু কর ;
ঘ) কৃষি শ্রমিক ও ভুমিহীন নর-নারী সকলকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আস
ঙ) স্বাস্থ্য সুবিধাসহ সকল কৃষককে স্মার্টকার্ড প্রদান করে এর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত কর ;
৬। ক)বিটি ব্রিঞ্জাল – গোল্ডেন রাইসসহ সকল প্রকার জিএমও বীজ, ফসল ও খাবার বন্ধ কর এবং কৃষিতে বহুজাতিক কোম্পানির দৌরাত্ম্য বন্ধ কর ;
খ)খাদ্যসার্বভৌমত্ব নিশ্চিত কর ও পরিবেশ-প্রতিবেশ বান্ধব কৃষি উৎপাদন এগ্রোইকোলোজী
চালু কর ;
গ) কমিউনিটি সিড ব্যংক গড়ে তুলতে কৃষকের জন্য সরকারের প্রণোদনা চাই ;
ঘ) বিএডিসিকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করে বেসরকারী বীজ কোম্পানির উৎপাদন ও বিপণন
বন্ধ কর ;
ঙ) গ্রামে-গঞ্জে কৃষি সমবায় ভিত্তিক উৎপা-দন ও বাজার ব্যবস্থা চালু কর ;
৭। ক) কৃষি জমি ব্যবহার ও সুরক্ষা নীতিমালা বাস্তবায়ন কর ;
খ) কৃষিজমি নগরায়ণ, শিল্পায়ন, গৃহায়ণ, ইটের ভাঁটা প্রভৃতি অকৃষি কাজে ব্যবহার বন্ধ কর ;
৮। সকল কৃষকদের সুদমুক্ত ঋণ দাও, এনজিওদের সুদি ব্যবসা ও মহাজনী দাদন ব্যবসা বন্ধ কর ;
৯। ক) পান-আখ-পাট-লবন চাষীদের জীবন-জীবিকার উন্নয়নে সরকারী উদ্যোগে এগুলোর বহুমূখী ব্যবহার নিশ্চিত কর ;
খ) চা শ্রমিকদের আবাদি জমিতে মালিকানার অধিকার ও তাদের কাজের ন্যয্য মজুরী দাও ;
গ) সাধারণ কৃষকদের মত সকল আদিবাসী, দলিত, রবিদাস সম্প্রদায়ের ভুমি অধিকার নিশ্চিত কর;
১০। করোনাসহ মহামারীকালে কৃষক-ভূমিহীন খেতমজুরদের টিকা প্রদানসহ বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত কর ;
১১। আইএলও কনভেনশন ১১ ও ১৪১ অনুসমর্থন ও আশু বাস্তবায়ন কর ।

কর্মসূচীঃ
• এ বছরের বিভিন্ন সময় দেশের ৪ টি বিভাগে কৃষক, ভূমিহীন ও খেতমজুরদের বৃহৎকার সমাবেশ
• এ বছরের শেষ দিকে জাতীয়ভাবে ঢাকায় একটি সমাবেশ
করোনার মধ্যেও কষ্ট করে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে আমাদের কথা শোনার জন্য আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। আশা করি আপনাদের বহুল প্রচারিত পত্রিকায় ও ইলেকট্রনিক প্রচার মাধ্যমে আমাদের সংবাদ ছাপিয়ে বিশেষভাবে কৃতার্থ করবেন।

পরিষদের শরিক সংগঠনের নামসমুহঃ
১। বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন ২ । জাতীয় কৃষক সমিতি ৩। জাতীয় কৃষক জোট ৪। বাংলাদেশ ভূমিহীন সমিতি ৫।বাংলাদেশ চাষী সমিতি ৬।বাংলদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন ৭।বাংলাদেশ জাতীয় কৃষক সমিতি ৮। বাংলাদেশ কৃষক সভা ৯। বাংলাদেশ কিষাণী সভা ১০। বাংলাদেশ আদিবাসী সমিতি ১১। বাংলাদেশ সংযুক্ত কৃষক ও খেতমজুর সমিতি ১২। সমগ্র বাংলা কৃষক সমিতি ১৩। সোনার বাংলা কৃষক কেন্দ্র ১৪। ভূমিহীন গণ পরিষদ ১৫। বাংলদেশ শ্রমজীবী আন্দোলন

আপনার মতামত লিখুন :