ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলেছে

প্রকাশিত : ৫ মার্চ ২০২২

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর সুযোগ সন্ধানীদের তৎপরতায় আবার দ্রব্যমূল্য বাড়তে শুরু করেছে। নয়না ভৌমিক পিংকি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার কর্মস্থল ঢাকায়। তার স্বামীও ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। পিংকির বেতন ২৭ হাজার টাকা। স্বামীর বেতন মিলিয়ে তাদের মোট আয় ৭০ হাজার টাকা। পরিবারে মোট সদস্য পাঁচজন। ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। পিংকি বলেন, বাসাভাড়া, বাচ্চার পড়াশুনা ও খাবারের পিছনে ব্যয় ছাড়াও চিকিৎসা ব্যয়সহ আরো নানা ব্যয় আছে। আমাদের দুইজনের আয়েও সংসার চালানো কঠিন। প্রতিমাসেই আমাদের ধার করতে হয়। ব্যাংক থেকে লোন নিয়েও সামলাতে পারছি না। কারণ, কিস্তি দিতে হয়। ধারদেনায় ডুবে যাচ্ছি।

তিনি জানান, এবছর তিনি ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন সাতশ’ টাকা। তার স্বামী বেসরকারি চাকরি করেন। কয়েক বছর ধরে ইনক্রিমেন্ট নাই। সাতশ টাকা আয় বাড়ার বিপরীতে ব্যয় বেড়েছে অনেক। তিনি বলেন, এবার শীতকালেও শাক-সবজির দাম কমেনি, উল্টো বেড়েছে। সয়াবিন তেল তো লাগামহীন। তার কথা, আমরা দুইজন চাকরি করেও কুলাতে পারছি না। যাদের পরিবারে একজন চাকরি করেন, তাদের কী অবস্থা তা আমি নিজের চোখেই দেখতে পারছি। দেশের অধিকাংশ মানুষই কষ্টে আছেন।

নাজমুল হক তপন সাংবাদিকতা করেন। করোনার প্রভাবে তার বেতন আগের চেয়ে কমেছে। এখন বেতন পান ৫০ হাজার টাকা। আগে টিভি, রেডিওতে অনুষ্ঠান এবং নানা জায়গায় লিখে বাড়তি আয় হতো। সেটাও আর নেই। ফলে তিনি পড়েছেন সংকটে। তার সন্তানসহ তিনজনের পরিবারে বাজার দরের সাথে আয়ের সামাঞ্জস্য রাখতে ভোগ ও সেবা কমিয়ে ব্যয় কমাতে হয়েছে। তিনি বলেন, এখন গরুর মাংস কেনা ছেড়েই দিয়েছি। মুরগির মাংস কিনছি, তা-ও পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছি। দুধ আগে কিনতাম মাসে সাত লিটার, এখন কিনি তিন লিটার। অফিসে যেতে-আসতে খরচ হতো ১০০ টাকা, এখন হেঁটে অফিসে যাই। জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ বলতে যা ছিল তা পুরোই বাদ দিয়েছি।

বাজার দরের পাগলা ঘোড়া মার্চের ৩ তারিখে সয়াবিন ও পাম অয়েলসহ ভোজ্য তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীরা। সরকার সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেও ব্যবসায়ীরা ভোজ্য তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বাজারে ভোজ্য তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। বাজারে এক ও দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয় যাচ্ছে না। দেশে পর্যাপ্ত সয়াবিন ও পাম অয়েল থাকলেও একটি সংঘবদ্ধ চক্র এই কাজ করছে। এদিকে এলপিজির দাম সরকার প্রতি সিলিন্ডারে ১৫১ টাকা বাড়ালেও বাজারে বেড়েছে আরো বেশি। বাজারের ওপরে যেন কারো নিয়ন্ত্রণই নেই।

চার বছরে যে কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বশি বেড়েছে তার মধ্যে সবার ওপরে আছে সয়াবিন ও পামঅয়েল। ২০১৯ সালে দেশের বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ১০৪ টাকা। ২০২২ সালে ১৭০ টাকা। পামঅয়েলের লিটার (খোলা) ২০১৯ সালে ছিল ৫৮ টাকা। ২০২২ সালে হয়েছে ১৫০ টাকা।

আরো কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চালের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে চিকন চালের কেজি ছিল ৫৩ টাকা, ২০২২ সালে ৭৫ টাকা। প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ২০১৯ সালে ছিল ৩৪ টাকা, ২০২২ সালে ৫২ টাকা। ২০১৯ সালে প্যাকেটজাত আটার কেজি ছিল ৩২ টাকা, ২০২২ সালে হয়েছে ৫২ টাকা। আরেক নিত্যপণ্য চিনির দাম তো গত চার বছরে বেড়ে প্রায় দ্বিগুন হয়ে গেছে।

মুরগি এবং মাংসের বাজারও বেজায় বেসামাল হয়েছে গত চার বছরে। বাজারে এখন সবেচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া সোনালি মুরগির কেজি ২০১৯ সালে ছিল ২২০ টাকা, ২০২২ সালে হয়েছে ৩০০ টাকা। গরুর মাংসের কেজি ২০১৯ সালে ছিল ৫৪০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ টাকায়। এসব পণ্যের বাইরে মশুর ডাল, আদা, রসুন, লবণ, সব ধরনের মসলা, সব ধরনের মাছ এবং সব ধরনের সবজির দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।

মূল্যের চাপ সামলানো দায় কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর হিসেবে ২০২০ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে বেড়েছিল ৬.৫০ শতাংশ আর ২০১৮ সালে ৬ শতাংশ। ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এই সময়ে। আর এখন মুদ্রাস্ফীতি ১০ ভাগেরও বেশি। এরসঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত। যে যার মতো দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে যুদ্ধের অজুহাতে।

ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসেন বলেন, গত বছরের (২০২১) জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হিসাব আমরা করছি। তাতে শতকরা ১০ ভাগের বেশি হবে। আর এই বছরে যা শুরু হয়েছে তাতে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বলা যায় না। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। বরং অনেকের কমেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি দিয়ে হিসাব করলে চলবে না।

তিনি বলেন, বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ এবং মনিটরিং খুবই দুর্বল। একটি গোষ্ঠী এখন যুদ্ধের বাজার তৈরি করে মুনাফা লোটার ধান্দায় আছে। তাদের এখনই প্রতিরোধ করতে হবে। নয়তো পরিস্থিতি আরো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে। ভোক্তা অধিকারের দুই-একটি অভিযান দিয়ে কাজ হবে না। সরকারকে সর্বাত্মকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। গত নভেম্বরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিপিআরসি এক গবেষণায় বলেছে, তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। গত বছরের মার্চে এই সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৪৫ লাখ। তারপর ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন।

নাজের হোসেন বলেন, আয় যদি বাড়েও তাতে লাভ নেই, কারণ, ব্যয় বাড়ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তাহলে প্রকৃত আয় বাড়বে। নয়তো প্রকৃত আয় কখনোই বাড়বেনা। আয় কখনোই ব্যয়ের নাগাল পাবে না।

যুদ্ধের বাজারে করণীয় কী? অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন ২০২০ সাল থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও চালের দাম বেড়েছে অনেক। তার কথা, আমদানি করা পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে বাড়লে এখানেও বাড়বে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অনেকে এর অনৈতিক সুযোগ নেন। দেশের বাইরে বাড়লে আগে কম দামে আমদানি করার পণ্যের দামও তারা বাড়িয়ে দেন।

তিনি বলেন, বড় দেশ যখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন তার প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়ে। আমাদের এখানেও পড়বে। এখনো প্রভাব পড়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু এখনই সুযোগ সন্ধানীরা সক্রিয়। তার মতে, এর বাইরে করোনার সময়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। করোনা পরবর্তী সময়ে এর প্রভাব পড়ছে বাজারে। জিনিসপত্রের দাম সারা বিশ্বেই বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশে যুক্তির বাইরে দাম বাড়ছে।

এরজন্য বাজার মনিটরিংয়ের সাথে সাথে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের রেশনিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে। নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত যাতে এটা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকাররকে এখনই এর পরিকল্পনা করতে হবে বলে তার অভিমত। তিনি বলেন, আয় বৈষম্য বেড়েছে। দারিদ্র্যসীমার প্রান্তিক লাইনে বিপুল সংখ্যক মানুষ আছে। আর নিম্নমধ্যবিত্ত আছে সবচেয়ে কষ্টে। কারণ, তারা বলতেও পাবরছে না তাদের দুরবস্থার কথা। সূত্র: ডয়েচে ভেলে।

 

আপনার মতামত লিখুন :