চেচেনদের কেন সবথেকে বিধ্বংসী সেনা বলা হয়?

প্রকাশিত : ৭ মার্চ ২০২২

স্বার্থের দ্বন্দ্বে ইউক্রেনের মাটিতে চলছে রাশিয়ার আগ্রাসন। না এখন আর আগ্রাসন বলা যাচ্ছে না, বলতে হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে ভয়-আতঙ্ক, চলছে তুমুল আলোচনা। এরমধ্যে আল্লাহু আকবার প্রতিধ্বনিতে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে নেমেছে একদল মুসলিম সেনা। প্রশ্ন উঠছে এরা কারা, কোন স্বার্থে রাশিয়ার সঙ্গী হয়েছে তারা।

হ্যাঁ, এরা চেচেন আর্মি, যাদের বলা হয় রুথলেস আর্মি বা সবথেকে বিধ্বংসী সেনা। দলটির সেনাপ্রধানকে ধরা হয় এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ওয়ার্ল্ড লর্ড হিসেবে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন যে গত ১২ বছরে কোনও যুদ্ধে হারেনি তার অন্যতম মূল কারণ এই চেচেন আর্মি। সিরিয়াতে আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করে বিধ্বংসী হামলা রাশিয়া চালালেও মাঠপর্যায়ে মূল কাজটি করেছে এই মুসলিম চেচেন সেনারা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কারা এই চেচেন আর্মি? এদের ইতিহাসটাই বা কি? মুসলিম সত্তাই বা কীভাবে জড়িত তাদের সাথে। রাশিয়ার মধ্যে এক টুকরো চেসনিয়া কীভাবে এখনো সদর্পে একটি কট্টর মুসলিম দেশ হিসেবে গর্বের সাথে টিকে আছে? পুতিনের সাথেই বা তাদের কি সম্পর্ক?

চেচেন কারা?

চেচনিয়া রাশিয়ার ককেশাস অঞ্চলের একটি অংশ। এর পার্শ্ববর্তী আরও দুটি প্রজাতন্ত্র হলো ইঙ্গুশেতিয়া আর দাগেস্তান। দাগেস্তানে নানা জাতির বাস। চেচেন আর ইঙ্গুশরা বাকি অঞ্চলে বাস করে। অতীতে তারা নাখ নামক গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উত্তর ককেশাসের এই প্রজাতন্ত্রগুলোর বেশিরভাগ মানুষ ধর্মে সুন্নি মুসলিম।

তেল সমৃদ্ধ ককেশাস নিয়ে সেই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে লড়েছে পারস্য, রাশিয়া আর অটোমান তুরস্ক। চেচেনরা বরাবরই নিজেদের সুবিধামতো কোনো একটা পক্ষ নিয়ে লড়াই করেছে, তবে রুশরা ছিল তাদের জাতশত্রু। ককেশাস অঞ্চলে এমন হাড্ডাহাড্ডি শত্রুতা নতুন কিছু না। রুশ বাদেও চেচেনরা নিজেদের প্রতিবেশী ওসেত কিংবা জর্জীয়দের দেখতে পারে না। বহু শত বছর ধরেই এই অঞ্চলটিতে এমন জাতিগত বিরোধ চলে আসছে।

১৯১৭ এর বলশেভিক আন্দোলনের ডামাডোলের মধ্য দিয়ে চেচেনরা তাদের প্রতিবেশী ইঙ্গুশ আর দাগেস্তানের অন্যান্য জাতিগুলোর সাথে মিলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে, তাদের সহায়তা করছিল জার আমলের সেনাদল। ১৯২১ সাল নাগাদ বলশেভিকেরা গোটা অঞ্চলটাকে রাশিয়ার সাথে জুড়ে নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে চেচনিয়াকে স্বায়ত্ত্বশাসনের কিছু সুবিধা দেওয়া হয়, শিক্ষা-দীক্ষার হার বৃদ্ধির পাশাপাশি জীবনযাত্রার মানও বাড়ে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বহু চেচেন আর ইঙ্গুশ যোদ্ধা বীরত্ব দেখিয়েছিলেন সোভিয়েতদের পক্ষে। অথচ ১৯৪৪ সালে তাদের লাখে লাখে জবরদস্তি করে পাঠানো হয় কাজাখস্তানে। সেখানে বহু লোক মারা পড়ে।

কেন সোভিয়েতরা চেচেন আর ইঙ্গুশদের সরিয়ে নিচ্ছিল তা নিয়ে নানা মতবাদ আছে। বহুল প্রচলিতটি হচ্ছে, স্ট্যালিন তুরস্কে অভিযান চালাতে ইচ্ছুক ছিলেন। মুসলিম ককেশীয়দের ওপরে ভরসা করতে না পারার কারণেই তাদের এভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া যুদ্ধের সময় কিছু চেচেন সোভিয়েতবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। পরে খ্রুশ্চেভের আমলে অধিকাংশ চেচেন ফেরত আসেন। এখান থেকেই শুরু হয় অভিবাসী রুশদের সাথে চেচেনদের গোলমাল। ককেশাসে রুশ ভাষার প্রাধান্য বিস্তার, রুশিদের জমিজমা বৃদ্ধি- এগুলো চেচেন বা ইংগুশ জনগণ ভলোভাবে নেয়নি। ষাটের দশকে দুই পক্ষের মধ্যে এসব নিয়ে কয়েক দফা ভয়াবহ দাঙ্গা হয়।

এবার মূল কথায় ফিরে আসি, সহজ ভাষায় বললে ভারত দেশটি যত বড় এমন ৫-৬টি দেশ একত্র করলে একটা রাশিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন দেশের জন্ম হয়েছে। এ অঞ্চলে শত শত বছর পূর্বে মুসলমানদের বাস ছিল। সোভিয়েত মুসলমানরা কালের বিবর্তনে একটি গোষ্ঠী আকারে এই এলাকাতে বসবাস করতে শুরু করে। রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে এই গোষ্ঠীকে চেচনিয়া নাম দেওয়া হয়। অনেকেই চেচনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র মনে করলেও এরা আসলে স্বাধীন দেশ নয়, রাশিয়ার একটি প্রদেশ। রাশিয়ার একমাত্র চেচনিয়াতেই মুসলমানদের বসবাস ছিলও।

১৯৯৪ সালে চেচনিয়া স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য বিদ্রোহ করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে, তারা আর রাশিয়ার সঙ্গে থাকতে চায় না। চেচনিয়া এ যুদ্ধে রাশিয়ার সঙ্গে হেরে যায়, এবং বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। ভ্লাদিমির পুতিন তখনো রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেননি। চেচনিয়া সংকট বাড়তেই থাকে। কারণ চেচনিয়ান মুসলমানরা মোটেই অন্য দেশের মুসলমানদের মতো নয়। এরা যেমন শক্তিশালী তেমন শিক্ষিত। সেইসাথে অত্যন্ত পারদর্শী রণকৌশলে। সর্বোপরি এরা রুশ মুসলমান। ১৯৯৯ সালে চেচেনরা এবারও রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই। এবার তারা আরও বেশি ধংসাত্মক হয়ে উঠল, তারা প্রায় ১০০ রাশিয়ানকে হত্যা করে ফেলে।

রাশিয়া এবার সর্বশক্তি খাটিয়ে চেচেনদের পরাজিত করল। গুড়িয়ে দেওয়া হলো চেচেনদের রাজধানী শহর। শেষপর্যন্ত এবারও হেরে যায় চেচনিয়া। রাশিয়ার ক্ষমতায় তখন এসে পড়েছেন পুতিন, তাই চলমান সংকট নিরসনে পুতিন আকমত কাদিরবকে চেচনিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে এবং চেচনিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার শান্তিচুক্তি হয়।

চেচেনরা রাশিয়ার অভ্যন্তরেই শান্তিতে বসবাস করবে, অন্য নাগরিকদের মতই সকল সুবিধা ভোগ করবে, চেচনিয়ার বাজেট বা উন্নয়ন বাবদ সকল দায়িত্ব রাশিয়া পালন করবে। এরপরই চেচনিয়াতে শান্তি ফিরে আসে এবং দেশটিকে নতুন করে সাজানো হয়। কিন্তু ২০০৪ সালে প্রেসিডেন্ট আকমত কাদিরবকে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে মেরে ফেলে চেচনিয়ার বিদ্রোহীরা।

এ ঘটনার সাথে সাথে পুতিন এমন একজন মানুষকে ডাকেন যিনি হচ্ছেন বিধ্বংসী ওয়ার্ল্ড লর্ড চেচেন আর্মির প্রধান রমজান কাদিরাভ (Ramzan Kadyrov)। রমজান হচ্ছেন আকমত কাদিরাভের ছেলে। বাবার মৃত্যুর পর তিনিই দেশটির ক্ষমতায় বসেন। এই রমজান ছিলেন ব্লাকবেল্ট জুডোকি, চেচনিয়ার ডিফেন্স হেড। যার বিরুদ্ধে শত শতর গুম-খুনের মামলা পর্যন্ত ছিল। তবুও পুতিন তাকেই বেছে নিলেন। রাতারাতি চেচনিয়ায় যতগুলো বিদ্রোহী সংগঠন ছিল সবাইকে গুম করে ফেলা হয় এবং চেচনিয়া নতুন সাজে সাজতে শুরু করে।

চেচনিয়ার বাজেটের ৮০ শতাংশ ব্যয়ভার রাশিয়া বহন করে। সেইসাথে রিয়ালেস্টেট ব্যবসায় তারা বিশাল লাভের মুখ দেখে। রমজার চেচেন আর্মির বাইরে নিজের নামে সম্পূর্ণ মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে। যাদেরকে বলা হয় ‘কাদিরাবাদসি’। রাশিয়ার বিশাল একটা অর্থ চেচেন আর্মি গঠনে খরচ হতে শুরু করলো, তাদের তৈরি করা হলো রুথলেস আর্মি বা বিধ্বংসী সেনা হিসেবে। আক্ষরিক অর্থে চেচনিয়ায় শান্তি ফিরে এলো।

আসলে চেচনিয়া পুরোপুরি একটি মুসলিম দেশ। কট্টর অনুশাসন মানা হয় এখানে। নারীদের ইসলামি পোশাক পড়তে হয়, চমৎকার সব মসজিদে সয়লাব অঞ্চলটি। তাদের আদি পুরুষদের সকল রীতিনীতি পালন করা হয় ঢালাও করে। প্রায়ই যে আমরা শুনি রাশিয়ায় সমকামীকে হত্যা করা হয় এগুলো মূলত এই চেচনিয়াতেই ঘটে থাকে। এখানে সমকামী শুধু নিষিদ্ধই নয় ঘোরতর অপরাধ। সমকামীদের প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনাও রয়েছে এখানে। এ বিষয়ের কেউ বিরোধিতা করলে গুম-খুনের ঘটনা ঘটে। সারাবিশ্বের মানবাধিকার সংস্থা থেকে প্রশ্ন উঠলে প্রেসিডেন্ট রমজান কাদিরাভের জবাব- চেচনিয়াতে কোনো সমকামী নেই, একজনও নেই। যেখানে কোনো সমকামী নেই সেখানে হত্যার প্রশ্ন আসে কীভাবে? বুঝতেই পারছেন রমজানের ডিক্টেটরশিপ কেমন বরবর।

২০০৪ সাল থেকে চেচনিয়ার শাসন ক্ষমতায় এই রমজান। রাশিয়ার দেওয়া অর্থে শুধু দেশের উন্নয়নই নয় পূরণ করে চলছেন নিজের সব শখ আহলাদও। নিজস্ব আর্মিকে পুরো ডেলে সাজিয়েছেন তিনি। আর এই আর্মিদের অনুশীলন এতটাই বর্বর যে সারা পৃথিবীতে এদের রুথলেস আর্মি বলা হয়। কোনো যুদ্ধে গিয়ে বর্বরতার বিচারে চেচেন আর্মি সবথেকে এগিয়ে।

কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে চেচেন আর্মি প্রধান একজন সেলিব্রেটি, ইনস্টাগ্রামে তার মিলিয়ন মিলিয়ন ফলোয়ারস। সারাদিন তাকে পোষা প্রাণীদের সঙ্গে মজা করতে দেখা যায়, দেখা যায় জুডো প্র্যাকটিস করতে, নামাজ পড়তে কিংবা সাইকেল চালাতে। চেচনিয়ার মোট জনসংখ্যার থেকে রমজানের ফলোয়ার্স প্রায় ছয়গুণ বেশি। তবে এসবের আড়ালে তিনি যে কতটা ভয়ংকর সেটা একটু গভীরে না গেলে বুঝতে পারবেন না।

২০১৭ সালে রমজানকে সবথেকে ভয়ংকর ওয়ার্ল্ড লর্ড ঘোষণা করা হয় এবং মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যে কারণে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম থেকে তাকে ব্যান করা হয়। রমজান রাশিয়ার বাইরে কোনো দেশে যেতে পারবে না। তার প্রয়োজনও নেই তার। রমজান দিব্যি বেলারুশের প্রেসিডেন্টের খামারে গিয়ে স্ট্রবেরি তুলছেন, পুতিনের ছবি সাঁটানো টি-শার্ট পড়ে রাশিয়ায় এসে জন্মদিন পালন করছেন। সেলিব্রেটিদের ডেকে আড্ডা দিচ্ছেন, সাপ ধরছেন, সিংহ কোলে তুলে মজা করছেন।

রমজানের কাজ হচ্ছে চেচনিয়াতে শান্তি-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করা আর পুতিনের প্রতি অনুগত থাকা। সিরিয়ায় রাশিয়া আক্রমণ করবে সেখানে রুশ সেনাদের জীবন নাসের প্রয়োজন নেই। পুতিন পাঠাচ্ছেন চেচেন আর্মিদের। তারা গিয়ে বর্বরতা চালাচ্ছে রাশিয়ার পক্ষ হয়ে। ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে ইউক্রেনে অবস্থান করছে চেচেন আর্মি, যারা সবাই ফ্রন্ট লাইনার সৈনিক। যেমন সাহসী তেমন বিধ্বংসী। রাশিয়া যুদ্ধের সময় প্রচলিত ছিল- একজন চেচেন আর্মি ১০ জন রুশ সেনার সমান। এতোটাই সামর্থ্যবান এ সেনারা।

হলিউড নানা সিনেমায় এই চেচেন আর্মিদের কথা উঠে এসেছে, বুঝতেই পারছেন সেগুলো ভিলেন হিসেবে! স্রেফ গল্প-কাহিনি। তারা যেমনটি দেখায় আর কি। বাস্তবেও এই চেচেন আর্মিদের সম্পর্কে বেশি তথ্য পাওয়া যাবে না। এদের কতো সৈন্য রয়েছে, কি ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে এসব তথ্য পুরো ইন্টারনেট জুড়ে কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে এতটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়, চেচেন আর্মিরা রাশিয়ার পুরো ডিফেন্স সোর্সই ব্যবহার করতে পারে প্রয়োজনে। সেক্ষেত্রে এরা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে সেটা বোঝাই যায়।

মনে হতেই পারে পুতিন চেচেনদের ব্যবহার করে ফায়দা লুটছেন। সেটাতো অবশ্যই, সেইসাথে চেচনিয়ার বিদ্রোহ পুতিন যেভাবে ডিল করেছেন সেভাবে কে পেরেছে! আফগানিস্তান হোক, ইরাক, ইরান কিংবা লিবিয়া, আমেরিকা এসব দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে বছরের পর বছর অশান্তি করেই গেছে। সেই তুলনায় চেচনিয়া সংকট পুতিন নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছেন। সরকারি বাহিনীর সাথে চেচেন সেনারা লড়ছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। নেতৃত্বের বিচক্ষণতা তো বলে একেই।

যুদ্ধবিদ্ধস্ত অঞ্চলটি অবশ্য এখনো জঙ্গীদের নাগালে পড়বার আশঙ্কায় আছে। কাজেই চেচনিয়ার শান্তি কতটা টেকসই তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

লেখক : শিহাব জাহিদ, সংবাদকর্মী

আপনার মতামত লিখুন :