পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের প্রাণের উৎসব

প্রকাশিত : ১৩ এপ্রিল ২০২২

সাইদুর রহমান: বৈশাখ মানে পাকাধানের মৌ মৌ গন্ধ, আম্রকাননে ঝুলন্ত আমের ছড়া, শিমুল ফুলের খোলস ফাটা উড়ন্ত তুলা, ঝড়ের ভয়ে ভয়ার্ত কোন মানুষের আর্তনাথ, সারা বছরের সঞ্চিত উচ্ছ্বাসের চারণভূমি। উৎসব মানে আপনজন অথবা আত্বীয় স্বজনদের সাথে মিলনের সেতু বন্ধন তৈরী করে। মানুষ দিনে দিনে যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে ।আত্বীয়- স্বজনদের খোঁজ খবর নেওয়ার সময় করোও নেই। বৈশাখের বৈশাখী টানে সবাই মিলিত হয়, গ্রামে অথবা শহরে, রোদেলা দুপুরে কিংবা শেষ বিকালে ।বাঙালী জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পহেলা বৈশাখের প্রাধান্য দিতেই হবে । আমাদের হাজার বছরের পুরোনো সংস্কৃতি আজ আকাশ সংস্কৃতি আর স্যাটেলাইট সংস্কৃতির বেসামাল আগ্রাসনে শঙ্কিত ।

করোনা মহামারির প্রচন্ড চাপে আমাদের প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ বেশ কয়েকটা বছর বিবর্ণ দশায় অতিবাহিত করেছে।
এ বছর বাংলাদেশীদের ঐতিহ্যবাহি ” মঙ্গল শুভ যাত্রা ” গ্রিনিচ বুকে নাম উঠানোর সূবর্ণ সুযোগকে দেশবাসী কাজে লাগাতে চায়।
” আমার সংস্কৃতি আমার নিজস্বতায় ভরপুর থাকবে ” পহেলা বৈশাখ একমাত্র উৎসব যেখানে, ধর্ম, রাজনৈতিক মতপার্থক্য অবহেলিত ও অগ্রহণযোগ্যা । সবাইকে একই সমান্তরাল রেখার নিয়ে একই আমেজে আনন্দিত করে। পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের একান্ত নিজস্ব উৎসব ।এখানে একটাই মন্ত্র আমরা বাঙালী। বৈশাখ এখন বিশ্বের বাঙালীদের সার্বজনীন উৎসব। আমাদের দেশের অনেকেই পহেলা বৈশাখ হিন্দুদের উৎসব বলে আখ্যায়িত করেন । পহেলা বৈশাখকে ধর্ম, বর্ণ দিয়ে হিসাব করা যাবেনা।

বর্তমানে যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো । তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃৃষিকাজ । ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষকের কাজ থেকে খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে, মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন । বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু করেন । আকবরের সিংহাসনে আরোহণের পর থেকে বাংলা সনের গননা শুরু। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন নামান্তর হয় । আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়।। বাঙালী জাতিকে একই সমতলে একত্রিত করার লক্ষে হয়তোবা সম্রাট আকবর পহেলা বৈশাখের সূচনা করেন । এই সার্বজনীন উৎসবকে ধর্মের দোহাই দিয়ে শক্তিহীন করা যাবেনা, মানুষের প্রাণের উচ্ছ্বাসকে প্রতিহত করা যাবেনা।

পহেলা বৈশাখে বাঙালী জাতির বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করে তুলার এক সুবর্ণ সুযোগ । আমাদের সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে যে কোন জাতির সংস্কৃতির ভালো দিকটা গ্রহনের পক্ষে । কোথাও গেল, সেই জারি- সারি গান, হৃদয় উজার করা ভাটিয়ারী গান, যাত্রাপালা, ষাঁড়ের লড়াই, সার্কাস আর জাতীয় খেলা হা ডু ডু আজ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে । হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে ফিরে পেতে গ্রামে, শহরে প্রতিটি স্হানে পহেলা বৈশাখে এসব সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে হবে । আমরা বাঙালী থাকবো কিন্তু আমাদের কোন অতীত থাকবেনা তা হতে পারেনা।শুধু বছরে একদিন বাঙালী হতে চাইনা । সারা জীবনের জন্য বাঙালী হতে চাই।

অপশক্তির কু- নজর থেকে পহেলা বৈশাখকে রক্ষা করতে হব। । আমাকে আমার মতো করে পহেলা বৈশাখ করতে দিন। বাঙালীদের প্রাণের উচ্ছ্বাসে কোটি মানুষের ঢলে, সকল ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারকে গলা ধাক্কা দিয়ে চিরবিদায় দিতে চাই । নতুন বছরে সকলে মিলে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে চাই। যেখানে থাকবেনা মাদক, শিশু নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, ধর্মীয় গোঁড়ামি, ও ধর্ষণের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা । যারা ধর্ষক অথবা যৌন নির্যাতনকারী তাদের কপালে সবাই মিলে চেপে ধরে এঁকে দিব অপশক্তির চিহ্ন । শিশু নির্যাতনকারীকে সমাজচ্যুত করবো অথবা তাদের নির্যাতনকারীর অঙ্গ গুলিকে বিকল করে দেবার প্রত্যয় নিব।

সাবধান! অপশক্তি, নতুন বছর ১৪২৮ সনের পহেলা বৈশাখ হবে অপ্রতিরোধ্য, সামাজিক অবক্ষয় পরিস্কারের ধারালো অস্ত্র । আমরা বাঙালী, বাঙালী আমাদের আদিসত্বা । আমরা সজাগ ও জাগ্রত অপশক্তির বিরোদ্ধে । আমাদের আদিসত্বাকে কেউ কলঙ্কীত করতে চাইলে আমরা ঘুমন্ত অথবা সুপ্ত থাকবোনা । জাগ্রত হবো আপন মহিমায়, অপশক্তির কন্ঠকে স্তব্ধ করার জন্য । অপশক্তির অশুভ গর্জনে আমরা ভীত বা শঙ্কিত নই ।

আমরা শুধু শঙ্কিত অপসংস্কৃতি অনুপ্রবেশ নিয়ে । অন্য জাতির বিকৃত সংস্কৃতি আমাদেরকে নেশাগ্রস্থ করতেছে। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস আর happy new year পালনে ব্যস্ত অনেক বাঙালী । এটা আমাদের সংস্কৃতির সাথে বরই বেমানান।অবাঙালী সংস্কৃতি গ্রহণে যদি আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয় তাহলে গ্রহণের পক্ষে।

পহেলা বৈশাখ সার্বজনীন। কিন্তু পান্তা ভাত আর ইলিশ সার্বজনীন নয়, অথবা ইলিশের সাথে পান্তা ভাতের কোন সম্পর্ক নেই । পান্তা ভাত হলো গরীবের নিত্যদিনের খাবার । তা খাওয়ার জন্য গরীবের কাঁচা মরিচেই যথেষ্ট । বতমানে এক তালা পান্তা ভাত বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৫০০ টাকায়। তাতে করে গরীবের নিত্যদিনের খাবারকে উপহাস করা হচ্ছে । পান্তা ভাত অথবা সোনার হরিণ ইলিশের পিছনে সকালে এত টাকা খরচ না করে, বিবস্ত্র গরীবের গায়ে কাপড় দান অনেক শ্রেয় ।

লেখক ও কলামিস্ট ।

আপনার মতামত লিখুন :