সারের বাজারে নৈরাজ্য উৎপাদন কমবে আমদানি বাড়বে

প্রকাশিত : ৫ আগস্ট ২০২২

বৈশ্বিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় ইউরিয়া সারের দাম বাড়িয়েছে সরকার। তবে, সরকার শুধু ইউরিয়া সারের দাম বাড়ালেও খুচরা বাজারে সব ধরনের সারের দাম বাড়িয়েছেন বিক্রেতারা। এছাড়া সরকার বলেছে, সার পর্যাপ্ত রয়েছে। সংকট নেই। কিন্তু কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন অনেকে। কৃষিমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, এমন ঘটনা ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কৃষকরা বলছেন, এর আগে সেচ কাজে ব্যবহৃত ডিজেলের দামও বাড়ানো হয়েছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। তবে সরকার বলছে বর্তমান ব্যবহারের ২০% ইউরিয়া ব্যবহার কমালেও উৎপাদন কমবে না। ফলে উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে না। এই সিদ্ধান্তের প্রভাবও পড়বে না। কিন্তু কৃষি উৎপাদন গবেষকেরা বলছেন, এসব সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়বে। এর কারণে ধানের উৎপাদন কমে চালের আমদানি বাড়বে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকেরা।

যা বলছেন কৃষক ও ডিলাররা

বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার জম্মুদ্বীপ গ্রামের কৃষক ইয়ার হোসেন পাঁচ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেন। সামনে ইরি-বোরো ধানের আবাদ করবেন তিনি। কিন্তু সারের দাম বাড়ায় তিনি চিন্তায় পড়েছেন।

তিনি বলেন, “এক বিঘা জমিতে চাষ করতে দেড় থেকে দুই হাজার টাকার সার লাগে। এর মধ্যে ইউরিয়া কয়েকবার দিতে হয়। এর পর সেঁচ দিতে হয়। আরও অনেক খরচ আছে। এবার খরচ উঠে আসবে কি-না সন্দেহ আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ইউরিয়ার দাম বাড়ানোর পর অন্য সারের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন ডিলারেরা।”

রংপুর সদর উপজেলার কামরুজ্জামান বকুল এক একর জমিতে আমন ধানের চাষ করবেন। তিনি বলেন, “দাম বাড়ার ঘোষণা আসার পর পরই ডিলারেরা সারের গুদাম থেকে ইউরিয়া সার সরিয়ে ফেলেছেন। তারা বেশি দামে বিক্রি করবেন বলে এই সংকট তৈরি করছেন। একই সঙ্গে অন্য সারের দামও বাড়িয়েছেন তারা।  আমরা সার নিয়ে আতঙ্কে আছি।”

বানারীপাড়া বাজারের ডিলার কামাল হোসেন বিপ্লব নিজে অন্য সারের দাম বেশি নেওয়ার কথা স্বীকার না করলেও অন্যরা যে নিচ্ছে তা তিনি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, “যেখানে চাহিদা বেশি সেখানে ডিলারেরা অন্য সারের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন। কেজি প্রতি তারা তিন-চার টাকা বেশি নিচ্ছেন।”

বাংলাদেশে সারে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া হয়। সোমবার (১ আগস্ট) থেকে ইউরিয়া সারের কেজিতে ছয় টাকা বাড়তি দাম কার্যকর হয়েছে। এখন প্রতি কেজির দাম খুচরা পর্যায়ে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে ছিল ১৬ টাকা। ডিলার পর্যায়ে আগে দাম ছিলো ১৪ টাকা। এখন হয়েছে ২০ টাকা। কেজিতে ছয় টাকা বাড়ানোর পরও এখনো সরকারকে ৫৯ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।

আর সরকার দাম না বাড়লেও এখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৫ টাকার পটাশ ১৭ টাকায়, ১৬ টাকার ফসফেট বা ডিএপি বিক্রি হচ্ছে ২২ টাকায়। কৃষকেরা জানান, যে সার কিনতে আগে এক হাজার টাকা লাগত, এখন লাগছে এক হাজার ৫০০ টাকা।

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, “ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানোকে কেন্দ্র করে কেউ সংকট বা নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় দাম সমন্বয় করা হয়েছে।”

সারের পর্যাপ্ত মজুত বলছে মন্ত্রণালয়

কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে  যে, বাংলাদেশে সব রকমের সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। আমন মৌসুমে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা ছয় লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে ইউরিয়া মজুত আছে সাত লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন। অন্যান্য সারের মধ্যে টিএসপির আমন মৌসুমে চাহিদা এক লাখ ১৯ হাজার টন। মজুত আছে তিন লাখ ৯ হাজার টন। ডিএপির চাহিদা দুই লাখ ২৫ হাজার টন। মজুত আছে ছয়  লাখ ৩৪ হাজার টন। এমওপির চাহিদা এক লাখ ৩৭ হাজার টন। মজুত আছে দুই লাখ ১০ হাজার টন।

ইউরিয়ার ব্যবহার কমলেও উৎপাদন ঠিক থাকবে

কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কৃষকেরা আসলে না বুঝতে পেরে ইউরিয়া সার বেশি ব্যবহার করছে। ডিএপির মধ্যেই ইউরিয়া সার আছে। দাম বাড়ার কারণে ইউরিয়ার ব্যবহার কমবে। কিন্তু উৎপাদন ব্যাহত হবে না।

একই কথা বলেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) সচিলাবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “সারের দাম বাড়ার পরও কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়বে না। ফসলের জমিতে সুষম সার প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইউরিয়া সারের বর্তমান ব্যবহার কমপক্ষে ২০% কমালেও একই উৎপাদন পাওয়া যাবে।”

কৃষকেরা ইউরিয়া বেশি ব্যবহার করে স্বীকার করে সরকারের এই কৌশলের সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক সদস্য কৃষিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান।

তিনি বলেছেন, “কৃষকেরা ইউরিয়া বেশি ব্যবহার করে সত্য। তবে তার দাম বাড়িয়ে তো ব্যবহার কমানোর কৌশল ঠিক না । এর জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হয়। প্রশিক্ষণ দিতে হয়। আর ইউরিয়ার বিকল্প ডিএপির দাম তো কমানো হয়নি। তাহলে কৃষক সেটা ব্যবহার করবে কেন”

আমদানি বাড়বে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষক

কৃষিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান মনে করেন প্রকৃতিক দুর্যোগ তো আছেন সঙ্গে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের ফলে উৎপাদন কমবে।

তিনি বলেছেন, “এবার আউশের উৎপাদন মার খেয়েছে। বন্যা এবং খরার কারণে আমনের চাষ দেরিতে শুরু হচ্ছে। কিন্তু ইউরিয়া সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমন চাষ কম হবে। উৎপাদন কম হবে। এর পরে বোরো উৎপাদনও ব্যহত হবে।”

তার ব্যাখ্যা, “একটি সারের দাম বেড়ে গেলে কৃষক সেটা পোষাতে অন্য সারের ব্যবহারও কমিয়ে দেয়। আর জমিও পতিত থাকে। ফলে উৎপাদন কমতে বাধ্য। আর ইউরিয়ার সঙ্গে অন্য সারের দাম বাড়ারও প্রবণতা শুরু হয়েছে।”

তিনি বলেন, “সরকার এবার ১০ লাখ টন চাল আমদানি করেছে। এরপর হয়তো ১৫ লাখ টন আমদানি করবে। গ্যাসের অভাবে দুইটি সার কারখানা বন্ধ হওয়ায়  সার আমদানিও আরও বাড়বে। ফলে দুই দিক থেকেই ডলারের ওপর চাপ বাড়বে। তাই সারে ভর্তুকি কমানো ঠিক হয়নি।”

তার মতে, “সারের সাথে ডিজেলের দামও বাড়তি। ৭০ ভাগ সেঁচ হয় ডিজলে। শ্রমিকের মজুরি বাড়তি। ফলে কৃষক খুব বিপদে পড়বে।”

আপনার মতামত লিখুন :