আজ নারকীয় সন্ত্রাসী হামলার ১৮তম বার্ষিকী

প্রকাশিত : ২১ আগস্ট ২০২২

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে শূন্য করার চক্রান্তের ফসল ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা। তৎকালীন সরকারি দল বিএনপির মদদে এ হামলা হয়েছিল এমন আলোচনা প্রায় সব মহলেই চালু আছে। এ হামলা মামলার বিচারের রায়েও তৎকালীন বিএনপি জোট সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের সম্পৃক্তার প্রমাণ মিলেছে। এতে তৎকালীন সরকারের প্রত্যক্ষ মদদের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি গ্রেনেড হামলার দায়দায়িত্বের কথা কখনো অস্বীকার করেনি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, “ওনাকে (শেখ হাসিনা) মারতে কে যাবে?” এ হামলার বিষয়ে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়া ব্যঙ্গোক্তি, উপহাস, কটাক্ষ ও বিদ্রুপ করেছেন।’

আজ সেই বিভীষিকাময়, রক্তাক্ত একুশে আগস্ট। একটি নারকীয় সন্ত্রাসী হামলার ১৮তম বার্ষিকী। ইতিহাসে একুশে আগস্ট নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের দিন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে রাজধানী ঢাকায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সমাবেশে চালানো হয় এ হত্যাযজ্ঞ। গ্রেনেড হামলার ওই ঘটনা রাজনীতির ইতিহাসে কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই গ্রেনেড হামলার বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে বিএনপির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতি দেশে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। একটি রাজনৈতিক দলের সব নেতাকে এক মঞ্চে হত্যা করার পরিকল্পনা প্রমাণ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ওই শক্তির লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সংগঠন আওয়ামী লীগ ও তার সভাপতি আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভয়াবহ এ হামলা দেশের মানুষের মনোজগতেও এনেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। নির্মম এই গ্রেনেড হামলা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে তুলতে নিয়ামক হয়ে কাজ করেছে।’

আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘গ্রেনেড হামলা দলের অভ্যন্তরের ঐক্য আরও দৃঢ় করে তুলতে প্রভাব রেখেছে। হামলার শিকার আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে রক্ষা করার তাগিদে সবাই আরও বেশি দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছেন। দেশের রাজনীতিতে এ হামলার ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রেখেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোটবিরোধী আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। গ্রেনেড হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে সুফল লাভ করেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট, আমার কাছে মনে হয়, দুটো বড় প্রাচীর সৃষ্টি করেছে। এই প্রাচীর কীভাবে অপসৃত হবে, কাদের মাধ্যমে অপসারণ করা সম্ভব হবে, সেটা আমার জানা নেই। এ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল বা বাংলাদেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কথা বলতে আমি কখনো শুনিনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা আওয়ামী লীগকে কিছু সুফল দিয়েছে। দলটিকে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি পেতে সাহায্য করেছে। বিএনপি ও জামায়াত নিশ্চিতভাবে নিন্দিত হয়েছে। এভাবে দেখলে বলা যায়, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক লাভ হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, এই হামলা শুধু আওয়ামী লীগ ও এই দলের প্রধান শেখ হাসিনার ওপর হামলা নয়, এই পরিকল্পনা পুরো বাস্তবায়িত হলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি টিকে থাকত কি না, সন্দেহ।’

শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা আমার কাছে মনে হয়, রাজনীতির বিভেদকে আরও বড় ও স্পষ্ট করেছে। আমার কাছে এটাও মনে হয়, একুশে আগস্টকে কেন্দ্র করে দলের ভেতরে যে বন্ধুত্বের বন্ধন, সেটা আরও মজবুত হয়েছে। বলা যায়, ওই ঘটনার পরে শেখ হাসিনা আইকন হয়ে ওঠেন।’

সেদিন যা ঘটেছিল : ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট ছিল শনিবার। বিকেলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী সমাবেশ ছিল। প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে যাওয়ার কথা ছিল। এ কারণে মঞ্চ নির্মাণ না করে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে অস্থায়ী মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জে চেপে বিকেল ৫টার একটু আগে সমাবেশস্থলে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সমাবেশে কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যের পর তিনি বক্তব্য শুরু করেন।

বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে বক্তৃতা শেষ করে শেখ হাসিনা তার হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগোতে থাকেন ট্রাক থেকে নামার সিঁড়ির কাছে। ঠিক সেই মুহূর্তে শুরু হয় গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। ট্রাকে অবস্থানরত নেতারা এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মানবঢাল রচনা করে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। পরে ঘাতকরা শেখ হাসিনার গাড়ি টার্গেট করে গুলি চালায়। তাকে আড়াল করে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে জীবন দেন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ।

একুশে আগস্টের ঘটনায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। বাকিরা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নারী নেত্রী আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ আগস্ট মারা যান। এই বর্বরোচিত হামলায় নিহত হয়েছেন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন, ইসাহাক মিয়া প্রমুখ।

একুশে আগস্টের ঘটনার ১৪ বছর ১ মাস ২০ দিন পর হামলা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে ফাঁসির দ-প্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক দুজন এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত ১২ জন ও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডপ্রাপ্ত চারজন পলাতক রয়েছেন।

হামলা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারিক আদালত বলে, ‘২০০৪ সালের একুশে আগস্ট আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার হীন চেষ্টা চালানো হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় দেশীয় জঙ্গি সংগঠন আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সহায়তায় এ হামলা করে।’ আদালত আরও বলে, ‘রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস কাম্য নয়।’

ওই হামলার প্রতিবাদে ও নিহতদের স্মরণে ২০০৫ সাল থেকে প্রতি বছর সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী নানা কর্মসূচি পালন করছে আওয়ামী লীগ। এবারও কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। দলটির দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আজ রবিবার সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত বেদিতে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হবে। সোয়া ১০টায় প্রতিবাদ ও স্মরণ সভা করবে দলটি। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

আপনার মতামত লিখুন :