সিডনিতে শোকে, শ্রদ্ধায় এবং গৌরবে আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে স্মরণ

প্রকাশিত : ১ সেপ্টেম্বর ২০২২

সিডনি থেকে প্রকাশিত মুক্তমঞ্চ পত্রিকার আয়োজনে গত ২৭ আগস্ট, ২০২২, সন্ধ্যায় শোকে ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হলো প্রয়াত কিংবদন্তী সাংবাদিক ও মুক্তমঞ্চ পত্রিকার একজন উপদেস্টা, ভাষা দিবসের অমর গানের রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে। উক্ত স্মরণ সভাটিতে যেন এক সাংস্কৃতিক মিলনমেলা বসেছিল সিডনি প্রবাসী সুধীজনদের। আলোচকদের মধ্যে অনেকেই আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। ২০০০ এবং ২০০৫ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলেন। এই মহাত্মনের স্মরণে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কেউ হয়েছেন অশ্রুসজল, কেউ হয়েছেন বাকরুদ্ধ। মুক্তমঞ্চ পত্রিকার সম্পাদক আল নোমান শামীমের সভাপতিত্বে এবং উপন্যাসিক ড. শাখাওয়াৎ নয়নের সঞ্চালনায় আব্দুল গাফফার চৌধুরীর জীবন ও কর্মের বিভিন্ন বিষয়ে অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন শিক্ষাবিদ, কবি এবং রাজনীতিবিদ ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক নেহাল নেয়ামুল বারী, রাজনীতিবিদ গামা কাদির, কলামিস্ট এবং গল্পকার অজয় দাশগুপ্ত, বঙ্গবন্ধু কাউন্সিলের সভাপতি শেখ শামিমুল হক, প্রশান্তিকা ডট কম এর সম্পাদক আতিকুর রহমান শুভ, শিক্ষাবিদ এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক ড. কাইয়ুম পারভেজ, কবিতা পারভেজ, শিক্ষাবিদ এবং রাজনীতিবিদ ড. খায়রুল চৌধুরী, রাজনীতিবিদ প্রবীর মৈত্র, রাজনীতিবিদ শফিকুল আলম, শিল্পী এবং শিক্ষাবিদ ড. পলাশ বসাক, রাজনীতিবিদ সেলিমা বেগম, মোটিভেশনাল স্পিকার পল মধু, সাংস্কৃতিক সংগঠক ড. স্বপন পালসহ অনেক গুণীজন।

অস্ট্রেলিয়া আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন বলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের রাজনীতি দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, সেই দুর্দিনে এই আব্দুল গাফফার চৌধুরী জাতিকে পথ দেখিয়েছেন। ড. কামাল হোসেন প্রসঙ্গে একটা সময় তিনি শেখ হাসিনার সমালোচনা করেছিলেন, তখন অন্যান্য বুদ্ধিজীবিরা তাঁকে আওয়ামীলীগের রাজনীতির বাতিঘর শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা না হারাতে অনুরোধ করেন। তিনি সেই অনুরোধ রেখেছিলেন এবং আমৃত্যু তিনি জাতীয় বিবেকের ভুমিকায় অবিচল থেকেছেন’।

একুশে একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও সামাজিক সংগঠক নেহাল নেয়ামুল বারী বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে গাফফার চৌধুরীর অবদান, ভাষা আন্দোলনে অবদান উল্লেখ করে বলেন, এক জাতি একজনই গাফফার চৌধুরীর জন্ম দেয়। শহীদ দিবসের সঙ্গীতসহ গাফফার চৌধুরীর বিভিন্ন সাহিত্য প্রতিভার দিক আলোচনা করেন তিনি।

অত্যন্ত আবেগঘন বক্তব্যে হৃদয়ে দাগ কেটেছেন অজয় দাশগুপ্ত দাদা এবং ড. কাইউম পারভেজ। অজয় দাশগুপ্ত বলেন– “যতদিন এই পৃথিবীতে মাত্র একজন বাঙালি বেঁচে থাকবে ততদিন পর্যন্ত তাঁর লেখা ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি’ বেঁচে থাকবে”।

কাইউম পারভেজ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘একবার আমাকে একজন প্রশ্ন করেছিল– উনি (আব্দুল গাফফার চৌধুরী) তো শুধু একটি গানই লিখে গেছেন, আর কি অবদান আছে? আমি উত্তরে তাকে বলেছিলাম– জি, ওই একটি গানই একটি দেশ স্বাধীন হয়েছে। কে না জানে একাত্তরের এই স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল ওই ৫২ এর একুশে ফেব্রুয়ারিতেই। আর এই গানটাই ছিল তার প্রধান অস্ত্র, যেটা বাঙালি জাতি মনে রেখেছে’।

কবিতা পারভেজ আবেগ আপ্লুত কন্ঠে বলেন, আসলেই আমরা গাফফার চাচার জীবনকে নিয়ে যখন কথা বলছি, তখন তা উদযাপনই হবে, কেননা, এক জীবনে এতো অর্জন খুব বেশী মানুষের হয় না। কবিতা পারভেজ তাঁর পিতা এম আর আখতারের সাথে গাফফার চৌধুরীর গভীর সম্পর্কের গল্প শোনান।

বঙ্গবন্ধু কাউন্সিলের সভাপতি শেখ শামীম বলেন, বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছের মানুষটি ছিলেন গাফফার চৌধুরী। আওয়ামী লীগের রাজনীতির মাঠে কঠোর সমালোচক হলেও তিনি শেখ হাসিনা আর বাংলাদেশের প্রশ্নে ছিলেন কোমল হৃদয়ের একজন।

জনাব গামা আব্দুল কাদির দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলেন, আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে হারানোটা আমাদের জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা তাঁর লেখার জন্য সবসময় অপেক্ষা করতাম। তিনি চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবেন।

ড. খায়রুল চৌধুরী বলেন, ‘উলংগং ইউনিভার্সিটিতে আমার থিসিস লেখার সময় আমরা বাঙালি নাকি বাংলাদেশী এই বিতর্কের সেরকম কোনো টেক্সট পাচ্ছিলাম না; একমাত্র ভরসা ছিল আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা একটি বই এবং পত্র–পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ। যা আমাকে খুবই সাহায্য করেছে’। এছাড়াও তিনি বলেন, আমাদের সময়ের এই মহান মানুষটি আমাদের জাতিসত্ত্বার ইতিহাসকে টেক্সটচুয়ালাইজড করেছেন। তাঁর অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না’।

সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠক শফিকুল আলম গাফফার চৌধুরীর জীবনের বিভিন্ন দিক উল্লেখ করে বলেন, গাফফার চৌধুরী শুধুই লেখক বা গীতিকার বা কবিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্বাধীনতার চার মূল নীতির প্রশ্নে আমৃত্যু লড়াই করে যাওয়া সংগ্রামী পুরুষ। বাংলাদেশের আজ তাঁর মতো শক্ত কথা সহজে বলার কলমের কাছেই আশ্রয় খোঁজে।

সাবেক কাউন্সিলর রাজনীতিবিদ প্রবীর মৈত্র গাফফার চৌধুরীর পারিবারিক ঐতিহ্যের উপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, ‘হাজী ওয়াজেদ চৌধুরী, জওহরলাল নেহেরুর বাবা মতিলাল নেহেরুর সেক্রেটারি ছিলেন। অল ইন্ডিয়ান কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বার ছিলেন’।

আতিকুর রহমান শুভ বলেন, ‘তিনি ছিলেন আমাদের পাঠ্যপুস্তকের মতো। তাকে পড়ে পড়ে আমরা বেড়ে উঠেছি। যে বয়সটা ছিলো গল্প– উপন্যাস পড়বার ঠিক সেই বয়স থেকে আমরা তাঁর কলাম পড়তাম। কখনও দুর্বোধ্য মনে হতো না। গল্পের মতো করে তিনি আমাদের ইতিহাসকে বিশেষ করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে চিনিয়েছেন। এক্টিভিস্টের মতো কাজ করে গেছেন। আমার বন্ধুর ছোট ভাই এক ব্লগারকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনে বিদেশে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। পরীমণির মতো একজন চিত্রনায়িকার বাঁচার অধিকারকেও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। আসছে ফেব্রুয়ারির বইমেলায় তাঁর অসমাপ্ত জীবনীও বই আকারে আসছে। এই খবরটা আমি জানতাম। সেটাও সিডনির সুধীজনদের জানালাম’।

সাংস্কৃতিক সংগঠক ডঃ স্বপন পাল বলেন, গাফফার চৌধুরীরা অসাম্প্রদায়িক সমৃদ্ধিশালী যে বাংলাদেশের পথ দেখিয়েছেন, তা থেকে আমাদের সরে আসার কোনো পথ নেই।

আওয়ামী পরিবারের রাজনীতিক সেলিনা বেগম বলেন, গাফফার চৌধুরীরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল ছিলেন, ছিলেন বলেই বাংলাদেশকে বুকে ধারন করেছেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তৈরিতে জননেত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম আলোকবর্তিতা হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন।

অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগ নেতা এমদাদ হক বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে কালজয়ী লেখককে বাংলাদেশ মনে রাখবে।

ড. পলাশ বসাক বলেন, বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী অনেক বুদ্ধিজীবি আমরা দেখেছি; তাঁরা অনেকেই একটা সময়ের ডিরেইল্ড হয়ে গেছেন। কিন্তু আব্দুল গাফফার চৌধুরী আমৃত্যু দেশ ও জাতির পক্ষে অবিচল থেকেছেন। অসাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোষহীন।

কলামিস্ট পল মধু বলেন, গাফফার চৌধুরীর স্মরণ সভায় উনার স্মৃতির প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন আমাদের জন্য সম্মানের। এতো বড় মাপের মানুষকে আমরা সম্মান করছি, অনুভব করার চেস্টা করছি, এটি আমাদের জন্যও বড় সম্মান।

অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ড.পলাশ বসাকের কন্ঠে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে, দেশের গান গেয়ে শোনান মারিয়া মুন, তারপর আব্দুল গাফফার চৌধুরীর জীবন ও কর্মের উপর একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা পাঠ করেন শাখাওয়াৎ নয়ন। অতঃপর পলাশ বসাকের নেতৃত্বে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ এই অমরকাব্যগাঁথা সমবেতভাবে গেয়ে আলোচনা শুরু করা হয়।

এসময় আরাও উপস্থিত ছিলেন অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ প্রেস ও মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি মোঃ রহমতুল্লাহ, সহ-সভাপতি কাজি সুলতানা সিমি, শিল্পী আতিক হেলাল ও আফরীন মিতা, সিডনি বেঙ্গগলিজ ডট কমের আবু তারিক, অপু সারোয়ার, আবৃত্তিশিল্পী নুসরাত জাহান স্মৃতি, আবৃত্তিশিল্পী আরিফুর রহমান, আবৃত্তিশিল্পী ফরহাদ আসমার, সাংস্কৃতিক কর্মী নামিদ ফারহান, জে জে অপূর্ব, আসরাফ আরিস, জাহাঙ্গীর হোসেন, সামাজিক সংগঠক সাজ্জাদ হোসেন, কবি ফজলুল মিরাজসহ সিডনির সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলের পরিচিতজন।

কথাসাহিত্যিক শাখাওয়াৎ নয়নের তথ্যসমৃদ্ধ সঞ্চালনা আলোচনা সভাটিকে অলংকৃত করেছে। মুক্তমঞ্চ পত্রিকার সম্পাদক আল নোমান শামীম সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে নৈশভোজের আহবান জানান এবং অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

আপনার মতামত লিখুন :