সমিতির নামে গ্রাহকের আত্মসাৎকারী মূল হোতা আজাদ গ্রেফতার

প্রকাশিত : ১৯ অক্টোবর ২০২২

দেশের বিভিন্ন জেলায় ‘জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড’ এর নামে বিভিন্ন লোভনীয় প্রলোভন দেখিয়ে সাত সহস্রাধিক গ্রাহক হতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হওয়া চক্রের মূল হোতা আজাদকে রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব

র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, র‌্যাব এলিট ফোর্স হিসেবে আত্মপ্রকাশের সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন ধরণের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল ও মাদকবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি খুন, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই চক্রের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতার করে সাধারণ জনগণের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে র‌্যাবের জোরালো তৎপরতা অব্যাহত আছে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যারা বিভিন্ন সময়ে সাধারণ জনগণ ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকজন প্রতারককে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

সাম্প্রতিক সময়ে “জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড” নামে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ভূক্তভোগীরা মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, রাজশাহী, মাগুরা, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার সাধারন পেশাজীবী মানুষ এই প্রতারক চক্রটির খপ্পরে পড়ে ব্যবসায়ে অতিরিক্ত লভ্যাংশ প্রাপ্তির আশায় লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। বেশির ভাগ মানুষ তাদের সারাজীবনের কষ্টার্জিত জমানো অর্থ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। প্রতারক চক্রের সদস্যরা সাধারন মানুষের প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও বর্ণিত প্রতারণার ঘটনা প্রচারে দেশব্যাপী চাঞ্চল্য ও আলোড়নের সৃষ্টি হয়। ফলশ্রæতিতে র‌্যাব উক্ত ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ অক্টোবর ২০২২ তারিখ রাতে র‌্যাব-৩ এর অভিযানে রাজধানীর কল্যাণপুরে আতœগোপনে থাকা অবস্থায় প্রতারণাপূর্বক অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রের মূলহোতা ১। খন্দকার আবুল কালাম আজাদ (৫৩), পিতা-খন্দকার রওশন আলী, সাং-তারাগুনিয়া, থানা-দৌলতপুর, জেলা-কুষ্টিয়াকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

২০০৩ সাল থেকে “জনতা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি” নামে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার খন্দকার আবুল কালাম আজাদ নামের এক ব্যক্তি উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল পরিমান অর্থ জামানত হিসেবে গ্রহণ করত। এভাবে ২০১২ সাল পর্যন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যায়। ২০১৩ সাল হতে কুষ্টিয়া, খুলনা, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী জেলায় উক্ত প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে বৃহদাকারে “জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড” নামে প্রতিষ্ঠান শুরু করে। সহজ শর্তে ব্যবসায়ীদের জন্য মোটা অঙ্কের ও প্রান্তিক মানুষের জন্য ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের কার্যক্রম শুরু করে। গ্রাহকরা “তফশিলি ব্যাংক” মনে করে তাতে আমানত রাখতে শুরু করেন। অনেক ব্যবসায়ীকে প্রতিষ্ঠানটি মোটা অঙ্কের ঋণ প্রদানের কারনে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকে পড়ে ওই প্রতিষ্ঠানে। বিভিন্ন জেলা শহর গুলোতে দৃষ্টিনন্দন ও নামীদামি বাড়ি ভাড়া নিয়ে চাকচিক্যময় অফিস খুলে বসে। মূলত সে পরিবার কেন্দ্রিকভাবে ব্যবসা শুরু করে যেখানে তার স্ত্রী, ছোট ভাই এবং ভাইয়ের স্ত্রী মিলে উক্ত প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করত। এভাবে অল্প সময়ে তারা প্রচুর পরিমান অর্থ জামানত হিসেবে গ্রহণ করতে আত্মসাৎ করতে সক্ষম হয়।

২০১৭ সালে কুষ্টিয়া, খুলনা, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহীসহ প্রতিটি জেলা থেকে অফিস গুটিয়ে নিয়ে উক্ত প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আজাদসহ তার পরিবারের তথা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা সবাই গা ঢাকা দিলে বিষয়টি নিয়ে উক্ত জেলাগুলোতে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সর্বস্ব হারানো ভূক্তভোগীরা বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ, প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধনসহ ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাতে থাকে। ঘটনাটি সারাদেশে প্রচারিত হলে উক্ত জেলাগুলোর সর্বস্তরের মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সংঘটিত ঘটনায় প্রতারক চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনার জন্য র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ২০০৩ সালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে খন্দকার আবুল কালাম আজাদ “জনতা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি” নামে প্রতিষ্ঠানটি চালু করে। ২০০৫ সালে মেহেরপুর জেলা শহরের পুরাতন পোস্ট অফিস মোড়ে আওয়াল হোসেনের বাড়ির দ্বিতীয় তলা ভাড়া নিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানের পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে কুষ্টিয়া, খুলনা, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় “জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড” নামে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন শাখা চালু করে। যার সভাপতি ছিলেন মোঃ আবুল হাসেম ও সম্পাদক মোঃ নাহারুল ইসলাম। প্রতারক চক্রটি অতি সুকৌশলে উচ্চ মুনাফায় মানুষকে প্রলুব্ধ করে বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষের নিকট হতে কোটি কোটি টাকা জামানত সংগ্রহ করে। ২০১৭ সালে উক্ত সমিতির গ্রাহক সংখ্যা ৭-৮ হাজার হয় এবং গ্রাহকরা ১০ হাজার থেকে শুরু করে ১৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জামানত রাখে। সে ব্যবসা শুরুর পর থেকে জামানত গ্রহণের পাশাপাশি মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য জামানত প্রদানকারী গ্রাহকদের মুনাফা দেয়ার কার্যক্রমও চালায় তবে ব্যাবসা গুটিয়ে নেয়ার আগে সে প্রদানকৃত অর্থও গুছিয়ে নিতে থাকে। ২০১৭ সালে তার দেয়া হিসাব মতে তার নিকট রক্ষিত গ্রাহকদের সঞ্চয়-আমানতের পরিমান দাড়ায় প্রায় ৫০-৭০ কোটি টাকা। পরবর্তীতে গ্রাহকদের বিভিন্ন আশা দেখিয়ে তাদের নিকট হতে রক্ষিত সকল জামানতের অর্থ নিয়ে ২০১৭ সালে ঈদুল ফিতর এর ছুটিতে সে তার আঞ্চলিক সকল অফিস গুটিয়ে এবং সকল ফোন নম্বর একযোগে বন্ধ করে দিয়ে ঢাকার উত্তরায় এসে গা ঢাকা দেয়। পালানোর সময় মাঠপর্যায়ে তার প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রদত্ত ঋণের পরিমান ৩২ লক্ষ ছিল বলে সে জানায় যা সে আর সংগ্রহ করতে পারেনি।

জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক ও অর্থ সংগ্রহের জন্য গ্রেফতারকৃতের সাথে প্রায় আটশতাধিক কর্মী নিয়োজিত ছিল। যাদেরকে কোন প্রকার বেতন প্রদান করা হত না। তাদের গ্রাহকদের বিনিয়োগের মাধ্যমে বার্ষিক ১৮-২০% মুনাফার প্রলোভন দেখাত। এছাড়াও তারা গ্রাহকদের নিকট হতে উচ্চ মুনাফায় মাসিক ভিত্তিতে নিয়মবহিভর্‚তভাবে ডিপিএস এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করত বলে জানায়। তার এই প্রতিষ্ঠানটির টার্গেট গ্রুপ ছিল দিনমজুর, চায়ের দোকানদার, মুদি দোকানদার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণীর পেশাজীবী মানুষ। গ্রাহক বৃদ্ধির জন্য সে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ প্যাকেজ ও প্রনোদনা ঘোষণার মাধ্যমে প্রলোভন দেখিয়ে তাদের আকৃষ্ট করত এবং ফলশ্রুতিতে অল্প সময়ে তারা গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধিতে সক্ষম হন। তারা বেশকিছু গ্রাহককে উচ্চ মুনাফায় লোন প্রদান করে। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান না হলেও তারা ব্যাংকের মতই গ্রাহকদের নিকট হতে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ গ্রদানের কার্যক্রম পরিচালনা করত। গ্রাহকদের সংগৃহীত অর্থ তারা নিজস্ব অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছে। তারা এ পর্যন্ত প্রায় ৫০-৭০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে বলে জানায়। গ্রাহকদের তথ্যমতে সংগৃহীত টাকা পরিমান আরো বেশি হতে পারে। তার নামে কুষ্টিয়া, খুলনা, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী জেলার বিভিন্ন থানায় চেক জালিয়াতি ও প্রতারনাসহ সর্বমোট ৬০টি মামলা রয়েছে বলে জানায়। যার মধ্যে ৩৬ টি মামলার ওয়ারেন্ট রয়েছে।

গ্রেফতারকৃত আজাদ কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর ডিগ্রী কলেজ থেকে বিএ পাশ করে। ছাত্র অবস্থায় ইটের ভাটার ব্যবসা, ঠিকাদারী ব্যবসা, কুষ্টিয়ার একটি স্থানীয় পত্রিকার প্রচার সম্পাদক এবং একটি জাতীয় পত্রিকার আঞ্চলিক প্রতিনিধি ছিল। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর এলাকায় “জনতা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি” নামে প্রতিষ্ঠান চালু করে এবং পরবর্তীতে বৃহৎ পরিসরে “জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড” নামে প্রতিষ্ঠানের পরিধি বাড়ায়। পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ৪০টির মত অফিস চালু করে। এছাড়াও সে “ঠিকানা লিভিং লিমিটেড” নামে আরও একটি ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে ফ্ল্যাট তৈরী করে ক্রয়-বিক্রয় করত। উক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম করে নিজের জেলা কুষ্টিয়াতে ১৫ বিঘা জমি, ০১টি ০৬ তলা বিশিষ্ট ভবন, ০১টি ইটের ভাটা এবং রাজশাহীতে ১১ বিঘা জমি ক্রয় করে। আত্মসাৎকৃত অর্থ দিয়ে সে ঢাকার উত্তরায় বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও গাড়ি ক্রয় করে। তার স্ত্রীর নামে পোষ্ট অফিসে ২০ লক্ষ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট রয়েছে বলে জানা যায়। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকে তার একাউন্ট রয়েছে এবং একটি প্রাইভেট ব্যাংকে তার ২ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এছাড়াও নামে বেনামে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

আপনার মতামত লিখুন :