কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ইউরোপে পালানোর চেষ্টা করছিলেন ‘প্রতারক’ ছালাম


প্রকাশিত : ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির নিকট হতে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এবং অর্থ আত্মসাতের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মোঃ হাসান ছালামকে রাজধানীর মতিঝিল এলাকা হতে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৩।

১। র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে মাদক, অস্ত্র, জঙ্গিসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর শাহজাহানপুরে টিপু হত্যা, বহুল আলোচিত বিশ^জিৎ হত্যা, পলাতক মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত বাউল মডেল, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে গলা কেটে অটোরিকশা চালক হত্যা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকান্ড, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধীসহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর ও ক্লুলেস হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন ও বিভিন্ন মামলায় দীর্ঘদিনের পলাতক আসামিদের প্রতিনিয়ত আইনের আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণের প্রশংসা ও আস্থা অর্জন করেছে।

২। এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র‌্যাব-৩ এর একটি আভিযানিক দল রাজধানীর মতিঝিল এলাকা হতে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির নিকট হতে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এবং অর্থ আত্মসাতের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মোঃ হাসান ছালাম(৪১), পিতা-মোঃ আব্দুস ছালাম, সাং-পাড়াগ্রাম, থানা-চৌদ্দগ্রাম, জেলা-কুমিল্লাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

৩। ধৃত আসামি যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করত। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ জেমস্ সুপার শপ লিমিটেড, জেমস্ এন্ড জুয়েলার্স, মতিঝিলে মা টেলিকম, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে উজির আলী ট্রাভেলস, কুমিল্লা কান্দিরপাড়ে ডায়মন্ড গ্যালারি লিমিটেড, গুলিস্থানে জামিল কনস্ট্রাকশন এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, মালিবাগ টুইন টাওয়ারে এশিয়ান স্কাই শপ, বারিধারায় জেমস্ গ্রæপ, জেমস্ এ্যাগ্রোফুড লিমিটেড, জেমস্ গ্যালারি লিমিটেড, জেমস রিয়েল এ্যাস্টেট লিমিটেড। দ্রæত সময়ের মধ্যে অধিক মুনাফার আশায় সে একই সময় একাধিক প্রতিষ্ঠানে যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে বিনিয়োগ করতে থাকে। ফলশ্রæতিতে যখন সে দেখতে পায় সে ভালো মুনাফা করতে পারে তখন আরও অধিক বিনিয়োগের জন্য তৎপরতা চালায়। এসময় সে তার ব্যবসায়িক পার্টনারসহ আত্মীয় স্বজন এবং পরিচিত লোকজনের নিকট হতে উচ্চ হারে মাসিক লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে কোটি টাকার অধিক হাতিয়ে নেয়। কিছুদিন লভ্যাংশ দিলেও পরবর্তীতে সে লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। পাওনাদাররা টাকার জন্য নিয়মিত তাগিদ দিতে থাকলে সে টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে চেক প্রদান করলেও নির্ধারিত তারিখে তার একাউন্টে কোন টাকা পাওয়া যায় না এবং ব্যাংক কর্তৃক চেক ডিজঅনার করা হয়। এমনিভাবে সে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিত এবং টাকা ফেরত চাইলে পাওনাদারদের বিভিন্ন ধরনের হুমকি ও প্রাণনাশের ভয়ভীতি প্রদর্শন করত। এর ফলে পাওনাদারগণ তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে চেক জালিয়াতির মামলা দায়ের করে।

৪। এছাড়াও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ফাইন্যান্স, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক, ব্রাক ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইউসিবি ব্যাংক, ইবিএল, প্রাইম ব্যাংক এবং প্রিমিয়াম ব্যাংকসহ আরও বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে। প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠানসমূহের কয়েকটি মাসিক কিস্তি পরিশোধ করে পরবর্তীতে তা বন্ধ করে দেয়। নিদির্ষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও সেগুলো পরিশোধ না করায় এসকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তাকে বারবার চূড়ান্ত নোটিশ প্রদান করা হয়। এতেও কাজ না হলে তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে আর্থিক ঋণ খেলাপের দায়ে মামলা দায়ের করা হয়। বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক তাকে বারবার টাকার বিষয়ে মিমাংসা আলোচনা করার সুযোগ প্রদান করা হলেও সে কখনই বিজ্ঞ আদালতে হাজির হয়নি। এছাড়াও বিজ্ঞ আদালতে চলমান মামলা গুলোর শুনানিতেও সে কখনও হাজিরা দেয়নি। কৌশলে এসব ঋণের দায় এড়ানোর জন্য সে তার বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং দোকান বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কুমিল্লা এবং ময়মনসিংহে জমি ক্রয় করে। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে সে পান্থপথে তার আলিশান ফ্ল্যাট বিক্রি করে ডেমরা এলাকায় বন্ধুর বাসায় গাঁঢাকা দেয় এবং পলাতক থাকা অবস্থায় মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেশ ছেড়ে ইউরোপে পালিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।

৫। ধৃত আসামি ২০০৮ সালে কুমিল্লায় মাসিক হারে লভ্যাংশ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কতিপয় লোকজনের নিকট হতে অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ঢাকা চলে আসে। এখানে এসে বসুন্ধরা সিটিতে প্রথমে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে জেমস্ সুপারশপ নামে পাথরের ব্যবসা শুরু করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন ব্যক্তিসহ বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে সে বসুন্ধরা সিটিতে আরো ০৪ টি দোকান ভাড়া করে বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করে। সে বিভিন্ন জায়গায় ফ্ল্যাটের ব্যবসায় এসকল অর্থ বিনিয়োগ করতে থাকে। এছাড়াও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহকে পুজি করে ও জমি মরগেজ দিয়ে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে গ্রহণকৃত ঋণসমূহের বিপরীতে প্রথম কয়েকটি মাসিক কিস্তি পরিশোধ করে পরবর্তীতে তা বন্ধ করে দেয়। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তিদের নিকট হতে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করে তা পরিশোধে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে ২০১৮ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা চলতে থাকে এবং ২০২০ সালে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে তখন থেকে সে রাজধানীর ডেমরা, উত্তরা, কেরানীগঞ্জ ও মতিঝিল এলাকায় বিভিন্ন সময় গাঁঢাকা দিয়ে থাকে। তার বিরুদ্ধে অর্থঋণ জালিয়াতি, চেক জালিয়াতি ও নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একাধিক মামলা রয়েছে। এছাড়াও ব্যক্তিগত জীবনে তার স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় ২০১৯ সাল থেকে সে এবং তার পরিবার আলাদা বসবাস করে। তার ০২ ছেলে ও ০২ কন্যা সন্তান রয়েছে।

৬। ধৃত আসামিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, জেমস্ সুপারশপে (বসুন্ধরা সিটি) পার্টনারশীপে মাসিক ৫০ হাজার টাকা করে লভ্যাংশ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে গিয়াস উদ্দিন নামক এক ব্যাক্তির নিকট হতে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা নিয়ে আতœসাৎ করে। পরবর্তীতে গিয়াস উদ্দিন ধৃত আসামির নিকট হতে প্রতি মাসে তার লাভের টাকা চাইলে সে বিভিন্নভাবে তালবাহানা করতে থাকে। গিয়াস উদ্দিন সঠিকভাবে লাভের টাকা না পাওয়ায় নিরূপায় হয়ে তার মুলধন ফেরত চায়। তখন ধৃত আসামি হাসান ছালাম পাওনাদার গিয়াস উদ্দিনকে তার মুলধন ফেরত না দিয়ে উল্টো হুমকি প্রদান করে এবং তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে গিয়াস উদ্দিন নিরূপায় হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করে। উক্ত মামলায় ধৃত আসামির নামে ২০২২ সালে বিজ্ঞ আদালত যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেন এবং উক্ত রায়ের গ্রেফতারি পরোয়ানার প্রেক্ষিতে র‌্যাব-৩ কর্তৃক তাকে গ্রেফতার করা হয়।

৭। গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

আপনার মতামত লিখুন :

এই বিভাগের সর্বশেষ