দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ‘সাদা সোনা’ খ্যাত চিংড়ি মাছ রপ্তানি বন্ধ প্রায় ৪৬০ কোটি টাকার ক্ষতি

প্রকাশিত : ৩০ এপ্রিল ২০২০

শেখ সাইফুল ইসলাম কবির.সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, বাগেরহাট: বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতীকরোনাভাইরাসের প্রভাবে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হোয়াইট গোল্ড বা ‘সাদা সোনা’খ্যাত চিংড়ি শিল্পে ব্যাপক ধস নেমেছে। কারখানা বন্ধ থাকায় মাছ বিক্রি করতে পারছেন না খামারিরা।রপ্তানি বন্ধ থাকায় প্রায় ৪৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় স্থানীয় বাজারগুলোতে গলদা ও বাগদা চিংড়ির দরপতন ঘটেছে অস্বাভাবিক হারে।চিংড়ি শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের দ্রুত প্রয়োজনীয় বাস্তবমূখি পদক্ষেপ গ্রহনের দাবী জানাচ্ছে এ খাত সংশ্লিষ্টরা। চিংড়ি সহ সব ধরনের সাদা মাছের দাম কমে গেছে। এতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন খামারি ও ব্যবসায়ীরা।

বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী কভিড-১৯-এর কারণে ইউরোপসহ আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি আদেশ একের পর এক বাতিল মাছ কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।সরকার চলতি অর্থ বছরে হিমায়িত চিংড়ি থেকে আয়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারন করছে প্রায় ৩৬ কোটি ১১ লাখ হাজার ডলার। গত বছর এ খাতে আয় হয়েছিল ৩৬ কোটি ১১ লাখ ৪০ হাজার ডলার। অর্থাৎ গেল বারের চেয়েও আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কম ধরা হলেও প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস হোয়াইট গোল্ড বা সাদা সোনাখ্যাত এ খাতের রপ্তানি আয় কোথায় নিয়ে দাড় করায় সেটাই এখন দেখার বিষয়। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া হিমায়িত মাছের অর্ধেক যায় যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় দেশগুলোয়। দেশগুলো হলো জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য ও বেলজিয়াম। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ২০ শতাংশের মতো রপ্তানি হয় বেলজিয়ামে। করোনা ভাইরাসের মহামারীতে আক্রান্ত দেশগুলোর অন্যতম যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় দেশগুলো। এসব দেশ লকডাউনে থাকায় গত একমাসে ২৯০টি হিমায়িত চিংড়ির ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। যার আর্থিক মুল্য প্রায় ৪৬০ কোটি টাকা। অথচ ২০১৯-২০ অর্থ বছরের মে মাস পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানির মাধ্যমে ৫ হাজার ২ শ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। আর এই মাছের অধিকাংশ উৎপাদন হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বাগেরহাট,খুলনা ও সাতক্ষীরা এলাকার মৎস ঘেরে।

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি মোকাবেলায় মাছ কোম্পানিগুলো আপাতত চাষিদের কাছ থেকে মাছ ক্রয় বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ দেশের উপকূলীয় এলাকার প্রায় পাঁচ লক্ষ চিংড়ি চাষী ও চিংড়ি মাছ প্রক্রিয়াকরন কোম্পানিগুলোতে কর্মরত আরো পঞ্চাশ হাজার শ্রমিকের ভাগ্য অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে। প্রায় পাঁচ লক্ষ চিংড়ি চাষীরা কখনো রেনু সংকট,চিংড়ি ভাইরাস,কখনো রেনু আহরন ও সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা, চিংড়ি সংরক্ষণে অ্যামোনিয়া গ্যাস সংকট, চিংড়ি সরবরাহ করে ন্যায্যমুল্য না পাওয়াসহ নানামুখি সংকটে জর্জরিত। এরই মধ্যে করোনা ভাইরাস নতুন করে অজানা গভীর সংকটের কালোমেঘ আছরে পড়েছে তাদের উপর। মৎস চাষীরা ভাগ্য বদলের আশায় হোয়াইট গোল্ড বা ‘সাদা সোনা’খ্যাত চিংড়ি চাষে আগ্রহী হয়ে পরলেন ভাগ্য বিরম্বনায়। আর এই বিরম্বনা যেন সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি চাষীদের পিছু ছুটছেনা।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সূত্র জানাগেছে, দেশের হিমায়িত খাদ্য রপ্তানির বড় অংশই চিংড়ি। এক সময় এ খাতের প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি চিংড়ি থেকে আয় হয়। তবে এখনও ৭০ শতাংশের ওপরই আয় আসে চিংড়ি থেকে। দেশে প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর জমিতে সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ির চাষাবাদ হয়। চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন ২ লাখ ৩০ হাজার টন। চিংড়ি ও মাছ প্রক্রিয়াকরণের জন্য সারা দেশে রয়েছে ৭০টি প্রতিষ্ঠান। প্রক্রিয়াকরণ শেষে হিমায়িত খাদ্য বিশে^র ৬০টি দেশে রপ্তানি হয়। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া হিমায়িত চিংড়ির অর্ধেক যায় যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় দেশগুলোয়। দেশগুলো হলো জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য ও বেলজিয়াম। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ২০ শতাংশের মতো রপ্তানি হয় বেলজিয়ামে। চিংড়ি ছাড়াও কাঁকড়াসহ আরও কিছু পণ্য থেকে আয় আসে এ খাতে।

জানা গেছে, সম্প্রতি দেশীয় চিংড়ি রক্ষায় সরকারের কাছে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টস অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) গত বছর কিছু সুপারিশ পেশ করে। সেগুলো হলো বর্তমানে সরকার চিংড়ি চাষে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। এই প্রণোদনা বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করতে হবে। হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনায় যে ১০ শতাংশ আয়কর কর্তন করা হয় সেটা বন্ধ করতে হবে। সরকার যে সাদা জাতের চিংড়ি রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল সেটা প্রত্যাহার করার। এবং খুলনা অঞ্চলে দুটি এবং চট্টগ্রামে একটি ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার স্থাপন করতে হবে। চিংড়ি মাছের ভেতরে অপদ্রব্য পুশ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করা যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা কোন সুযোগ না পায়। চিংড়ি শিল্প বাঁচাতে ঐ সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্ত বর্তমান প্রাণঘাতী করোনা সংক্রমনের বাস্তবতায় বিএফএফইএ আরো অনেক দাবী সামনে চলে এসেছে। চিংড়ি শিল্প বাঁচাতে নতুন করে চিংড়িচাষী ও রপ্তানীকারকদের বিশেষ প্রনোদনাসহ কিছু পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান বলছে, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশের মাছ (হিমায়িত ও অন্য মাছ) রপ্তানি থেকে আয় হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১২ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আয় এসেছে ১২ কোটি ৫২ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার পূরণ হলেও আগের বছরের একই সমেয়র চেয়ে আয় কমেছে ৯ শতাংশের ওপর। গেল অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে মাছ রপ্তানি হয়েছিল ১৩ কোটি ৭৭ লাখ ডলারের। মোট মাছ রপ্তানির অধিকাংশই আসে হিমায়িত চিংড়ি থেকে। গেল ৩ মাসে চিংড়ি থেকে ৮ কোটি ৬০ লাখ ডলারের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ১০ কোটি ডলার। এ ক্ষেত্রেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও গেল অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আয় কমেছে। গেল অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল ১১ কোটি ৩০ লাখ ডলারের।

চলতি অর্থবছরে সরকার সব ধরনের মাছ রপ্তানি করে মোট ৫২ কোটি ডলার আয়ের লক্ষমাত্রা ঠিক করছে। গেল অর্থবছরে এ থেকে আয় ছিল ৫০ কোটি ডলার। এদিকে এ বছর চিংড়ি থেকে আয় আশা করা হচ্ছে ৩৬ কোটি ১১ লাখ হাজার ডলার। গেল বছর যাতে আয় হয়েছিল ৩৬ কোটি ১১ লাখ ৪০ হাজার ডলার। অর্থাৎ গেল বারের চেয়েও কম লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও করোনা ভাইরাসের প্রভাবের লকডাউন এ কতদিন রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান হিমায়িত চিংড়ি ফ্রিজিং করতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তবে সরকার কাঁকড়া ও অন্যান্য হিমায়িত মাছ থেকে আয় বাাড়নোর আশা করলেও সেখানেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।

পরিসংখ্যান বলছে, কয়েক বছর ধরেই অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির নিম্নমুখী রয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চিংড়ি থেকে ৫৫ কোটি ডলার আয় হয়। পরবর্তী বছরগুলোয় রপ্তানি কমতে থাকে। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫১ কোটি ডলার, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪৫ কোটি ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আরও ৪ কোটি ডলার কমে ৪০ কোটি ৪৭ লাখ ডলার এবং সর্বশেষ অর্থবছরে (২০১৮-১৯) তা নেমে আসে ৩৬ কোটি ডলারে। ৫ বছরের ব্যবধানেই সম্ভাবনাময় এ খাতে রপ্তানি প্রায় ১৯ কোটি ডলার কমে এসেছে। তবে রপ্তানিকারকরা বলেন, মাছের মধ্যে এ দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে হিমায়িত চিংড়ি। কিন্তু মাছে ভাইরাস,মানসম্মত রেনু, বঙ্গোপসাগরে চিংড়ির রেনু আহরনে নিষেধাজ্ঞাসহ নানা কারনে বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে কমছে চিংড়ির রপ্তানি আয়, যা মোট মাছের আয় কমিয়ে দিচ্ছে। নানা কারণে সংকটে পড়েছে দেশের চিংড়ির রপ্তানি বাজার। এর ফলে চরম বিপাকে পড়ছে চিংড়িচাষী, হিমায়িত চিংড়ি ডিপো,হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক,কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ এ শিল্পে নিয়োজিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভর করছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের তাগিদে সরকারকে দ্রুত চিংড়িচাষি ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বিপুল সংক্ষক শ্রমিক কর্মচারীদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

উল্লেখ, গত বছরের ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে চিংড়িসহ সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। ভরা মৌসুমে সাগরে সব ধরনের মাছ আহরণে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ দেশের উপকূলীয় এলাকার প্রায় পাঁচ লক্ষ চিংড়ি চাষী বাগদা চিংড়িসহ বিপাকে পড়েছিলো রেণু (পোনার) ব্যবসায়ী ও চিংড়িচাষিরা। ব্যাহত হয় উপকূলীয় এলাকার প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে বাগদা চিংড়ির চাষ। ফলে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের চিংড়িঘেরগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। পোনার অভাবে এরই মধ্যে অনেক ঘেরে চিংড়ির উৎপাদন কমে গেছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চিংড়িচাষিরা। এ সময় দেশের সব হ্যাচারিতে বাগদা চিংড়ির উৎপাদন বন্ধ থোকায় অসাধু কিছু চিংড়ি পোনা ব্যবসায়ী ও হ্যাচারি মালিকরা পাশের দেশ ভারত থেকে অবৈধভাবে আনা নিম্নমানের জীবাণুযুক্ত নপলি (সদ্য ফোটা বাগদা চিংড়ির পোনা) উৎপাদন করে তা ঘেরগুলোতে সরবরাহ করছেন। এতে ভাইরাসসহ নতুন রোগ-বালাই ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষাবাদ করেও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় চিংড়িচাষিরা। চিংড়িচাষিরা আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে ঠিক সেই সময় শুরু হয়েছে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণ। আর এই বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণে মুখে পড়েছে আমাদের দেশ, ইউরোপ,আমিরিকাসহ অধিকাংশ চিংড়ি ক্রেতা দেশ। রপ্তানিকারকরা জানান, মাছের মধ্যে এ দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে হিমায়িত চিংড়ি। কিন্তুকয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে কমছে চিংড়ির রপ্তানি আয়, যা মোট মাছের আয় কমিয়ে দিচ্ছে। এখন আবার শুরু হয়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ। ইতিমধ্যে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান বন্ধের কারনে শ্রমিক কর্মচারীরা পড়ে খাদ্য সংকটে। আর এই খাদ্য সংকটের জন্য ইতিমধ্যে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা কর্মসূচি লঙ্গন করে রাজপথে বিক্ষোভ প্রর্দশন করেন।

আপনার মতামত লিখুন :