অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম, বিশ্বাস হচ্ছিলো না খবরটি : রাশেদা রওনক খান

প্রকাশিত : ১৫ মে ২০২০

রাশেদা রওনক খান: অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম, বিশ্বাস হচ্ছিলো না খবরটি! কারণ এর আগেও কয়েকবার তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো, অদম্য শক্তি, সাহস আর দৃঢ় মনোবলের কাছে অসুস্থতা পরাজিত হতো, তিনি যেন নতুন করে আমাদের মাঝে ফিরে আসতেন| এবারও যখন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, শোনার পর থেকেই ভাবছিলাম তিনি সকল অপশক্তিকে পরাজিত করে ফিরবেন এই বিপুলা পৃথিবীতে| কিন্তু এবার সত্যিই চলে গেলেন… অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার আমাদের জন্য রেখে গেলেন তাঁর বিপুলা পৃথিবী!

এই বয়সেও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রিয় বাংলা বিভাগে নিয়ম করে বুধবার দিন আসতেন, মাঝে মাঝে একটু উঁকি মেরে কথা বলে যেতাম| শেষ যেই বার রুমে গেলাম, সেবার তাঁর বাংলা বিভাগের সাবেক ছাত্র আমার মা প্রফেসর জোহরা আনিসও সাথে ছিলেন| কথার মাঝে খুব কাশি দিচ্ছিলেন, কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো| মা বললেন, স্যার এর মাঝেও এসেছেন, আপনার তো গলায় রেস্ট দরকার| বললেন, “ও আমার সব সময় লেগেই থাকে, অভ্যাস করে নিয়েছি এর মাঝেই কাজ করতে হবে| ঘরে বসে থাকলেও কাশি, এখানে এলেও কাশি, একই কথা!” আমি হাসলাম উনার যুক্তি শুনে|

শেষ দেখা বাইরে চলে আসার আগে, সাংবাদিক-গবেষক Ajoy Dasgupta এর একটি গ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে| সেদিন তাঁর চোখের অবস্থা ভালো ছিলোনা, অপারেশন হয়েছে কদিন আগে| এর মাঝেও অনুষ্ঠানটিতে এসেছেন| একেই বলে কথা দিলে কথা রাখার উদাহরণ!

আমি কাছে গিয়ে বসতেই, কথার শুরুতেই জানতে চাইলেন, “জোহরা (আমার মা) কেমন আছে?”, আবার ড. জয়নাল (আমার খালু, তাঁর খুব প্রিয় ছাত্র) কেমন আছে? সেদিন বলে না, ক্যাম্পাসে দেখা হলেও জানতে চাইতেন| মনে মনে বিস্মিত হতাম, সেই ‘৭০ দশকের ছাত্র ছাত্রীদের নাম তিনি কিভাবে মনে রাখেন? আমি কি পারবো আমার ছাত্র ছাত্রীদের সন্তানদের ৪০/৫০ বছর পর দেখলে তাদের বাবা-মায়ের নাম ধরে জিজ্ঞাসা করতে? আগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক কতো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ছিল, ভাবা যায়? কতো যে স্মৃতি মনে হয় যেন জন্ম জন্মান্তরের!

যেবার ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’ পেলেন আমি আর আমার বোন গেলাম শুভেচ্ছা জানাতে| সারাদিন বসে আড্ডা স্যার আর ভাবির (নানু, ছোটবেলায় তাদের নানা নানু ডাকতাম বলে বড় বেলায় স্যারকে স্যার বললেও উনাকে নানুই ডাকতাম) সাথে| স্যারকেও ‘নানা স্যার’ও ডাকতাম মাঝে মাঝে| ভাবী (নানু) আমার মেজো খালা হামিদা মারা গেছেন শুনে বার বার দুঃখ করছিলেন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ বা সরকারী মহিলা কলেজে অনার্সের মৌখিক পরীক্ষা নিতে গেলে স্যার আমার এই মেজো খালু ড. জয়নাল আবেদিনের বাসায় যেতেন অনেক সময়, আমার খালা অনেক রান্না করতেন, সেই কথা বার বার বলছিলেন, সাথে নানুও যেতেন মাঝে মধ্যে|

বঙ্গভবনে সারোয়ার ভাইয়ের একটি বই প্রকাশনা উৎসবে গিয়ে নাশতার সময় আমি একটা প্লেটে করে খাবার তুলে বললাম, আপনি এখানে বসে খান, আপনাকে উঠে গিয়ে আনতে হবেনা| আমার দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি খেয়েছ? আমি বললাম, আমি খাবো| এমন সময় মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিজেই একটি প্লেট নিয়ে এগিয়ে এলেন উনাকে দেবার জন্য! শিখেছিলাম, শিক্ষক মানে এমনটিই হতে হয়! শ্রদ্ধা করবে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়! মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও দেখেছি উনাকে কিভাবে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতেন, শিক্ষকের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন লাল গালিচা, সেই ছবি কার না মনে আছে! এই সকল সম্মান তাঁর পাওনা! এই দুর্যোগময় মুহূর্তে জাতির একজন বাতিঘর হারিয়ে পুরো জাতি শোকে আজ মুহ্যমান|

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের দিন গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলাম বিদায়ের সময়| গাড়ীতে উঠে বলল, মাকে নিয়ে, কনককে (আমার বড় বোন, খুব স্নেহ করতেন ওকে) নিয়ে বাসায় এসো| আর যাওয়া হল না, স্যারই চলে গেলেন…..

একদিন কলাভবনে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন তিনি, আমি নামছিলাম খুব তাড়াহুড়া করে, প্রথমে খেয়াল করিনি যে স্যার নামছিলেন| হঠাৎ স্যারকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম, স্যার খুব ধীরে ধীরে এক পা দুই পা করে নামছেন| আমি সালাম দিতেই, আমাকে দেখে বলে, থেমে যেওনা, যেভাবে যাচ্ছিলে, সেভাবেই যাও| এটাই তারুণ্য, আর আমারটা বার্ধক্য! আমি হেসে বললাম, “আপনার আগে আমি কেন ২০ বছরের তরুণও দৌড়ে যেতে পারবেনা!” শুনে হেসে দিয়ে বলে, তুমি যে অর্থে বলেছ, সেই অর্থে এখন ছেলে মেয়েরা এভাবে শিক্ষকদের দেখলে দাঁড়িয়ে যায়না| আমি অনেক সময় দেখেছি, শিক্ষকদের গা ঘেঁষে শিক্ষার্থীরা চলে যায়, দেখেও না! অথচ এক সময় করিডোরে কোন শিক্ষক হাঁটতে দেখলে কোথায় যেন সব আড়াল হয়ে যেতো, এই কলাভবনের কথাই বলছি| তোমার মা’কে জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারবে| আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস লুকিয়ে বললাম, স্যার আমি শুনেছি উনাদের মুখে সেই সময়কার কথা…. উনি কথার পিঠেই বললেন, তাইতো শিক্ষক হয়েও তুমি আমার আগে যেতে চাইছো না| শিক্ষকের সন্তান বলে কথা! আমি এবার যোগ করে বললাম, “আপনাদের সান্নিধ্য পাওয়া ছাত্রদের সন্তান বলে হয়তো….” উনি মৃদু হাসির ভঙ্গিতে বললেন, যাও কোথায় যাচ্ছিলে, তোমার দেরী হয়ে যাবে| আমি বললাম, না স্যার আপনার গাড়ী আসুক| স্যার না যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলাম| স্যার গাড়ীতে উঠলেন, তারপর আমি গেলাম|

যেদিনেই কথা হতো, এভাবেই কথোপকথন চলতো, খুব অল্প দুটো হয়তো কথা হতো, কিন্তু তা মনে হতো সারাজীবনের সঞ্চয়! বাতিঘরেরা বোধহয় এমনই!
এক জীবনে অনেক আলো জ্বালিয়েছেন, সেই আলোয় আপনি আমাদের সমাজকে আলোকিত করেছেন, আপনাদের আলোয় ভরা এই সমাজে অন্ধকার নেমে না আসুক!

যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন! বিনম্র শ্রদ্ধা স্যার!

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

আপনার মতামত লিখুন :