ঢাকার দুই সিটিতে নির্বাচনের নামে প্রহসন

প্রকাশিত : ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

গত ১ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কেমন হবে এ নির্বাচন, এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল অনেক নাগরিকের মধ্যেই। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে যে নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার আশঙ্কাই অধিক, তার কারণ অতীতের অভিজ্ঞতা। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অতীতে একটা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সঙ্গত কারণেই দেশের দুই প্রধান দলের অন্যতম বিএনপি বয়কট করায় তাতে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল নিদারুনভাবে কম।

সে নির্বাচনে বিএনপি তো দূরের কথা, খোদ শাসক দল আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থক-সদস্যও ভোট দেয়ার জন্য ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। কারণ তারা জানতেন, তারা ভোটকেন্দ্রে না গেলেও তাদের ভোট দেয়ার ব্যবস্থা ঠিকই করা হবে দলের পক্ষ থেকে।

আসলে হয়ও সেটাই। ভোটকেন্দ্রে বিএনপির বয়কটজনিত অনুপস্থিতির সুযোগে এ অল্পসংখ্যাক আওয়ামী লীগ কর্মীরাই ইচ্ছামত বেশি বেশি সরকারি প্রার্থীদের ব্যালটপত্রে সিল মেরে তাদের অকল্পনীয় অধিক ভোটে বিজয়ী হওয়া নিশ্চিত করেন। এভাবে প্রকৃত ভোটারদের ব্যাপক অনুপস্থিতি সত্তে¡ও বিপুল ভোটে শাসকদলের বিজয় নিশ্চিত হওয়ার কারণে জনগণ ঐ নির্বাচনের নাম দিয়েছিল ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’। এর পরের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল অংশ নেয়ায় সেটি ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেও বিএনপিসহ অন্যান্য দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী মাঠে টিকতে দেওয়া হয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরিয়ে এবং নির্বাচনের দিন দেশব্যাপী কেন্দ্র দখল করে নিজেদের নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ফলে সে নির্বাচনকেও ‘প্রহসনের নির্বাচন’ হিসেবেই দেখছে দেশের মানুষ।

সর্বশেষ গত শনিবার নির্বাচন হয় ঢাকা সিটির উত্তর ও দক্ষিণ দুই নির্বাচনী এলাকায়। জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় সিটি নির্বাচনের গুরুত্ব যে অনেক কম, সে সম্পর্কে অবহিত ও সচেতন থাকার কারণে এবারের এ সিটি নির্বাচনে ভোট দিতে যাওয়ার আগ্রহ আমার ছিল না। কিন্তু এ সিটি নির্বাচন নিয়ে আমার লেখার ইচ্ছা ছিল বিধায় শেষ পর্যন্ত আমিও এ সিটি নির্বাচনে ভোট দিতে ভোট কেন্দ্রে যাই। সেখানে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়, এবার সে প্রসঙ্গে আসছি। ভোট কেন্দ্রের বাইরের রাস্তায় প্রচুর লোকজন ছিল, দেখে আমার ধারণা হয়েছিল, প্রচুর ভোটার হয়তো ভোট দিতে এসে থাকবে।

কিন্তু ভেতরে ঢুকে আমার এ ধারণা সম্পূর্ণ পালটে গেল। সাধারণত আমাদের দেশে ভোট দিতে গেলে যেভাবে লাইনে দাঁড়াতে হয়, তার কোনো আলামতই নেই। সুতরাং নির্বিঘেœই প্রায় ফাঁকা ভোট কেন্দ্রে ভোট দিয়ে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই বাসায় ফিরে আসতে সক্ষম হলাম। আসলে এর অর্থ কী? অর্থ হলো আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন যে আর নির্বাচন থাকে না, হয়ে যায় নির্বাচনী প্রহসন, তা জনগণের শুধু ধারণা নয়, বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া এটা তো জাতীয় নির্বাচন নয়, সিটি নির্বাচন, যার গুরুত্ব জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় অনেক কম, এটা বুঝতেও জনগণের বাকী নেই।

এবার ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের খবর দেশের গণমাধ্যমে কীভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, সে প্রসঙ্গে। দেশের অন্যতম বাংলা দৈনিক প্রথম আলো গত সোমবার প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান সংবাদ প্রকাশ করেছে যে শিরোনামে তা ছিল: ‘১৫-১৭% জনসমর্থন নিয়ে মেয়র’। দৈনিক নয়াদিগন্ত এ খবর প্রকাশ করেছে তার প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান প্রতিবেদন হিসাবে, যার শিরোনাম ছিল: ‘ভোটারের আস্থা ফিরল না’।

দৈনিক সমকাল পত্রিকায় গত সোমবার যদিও প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: ‘জয়ের বন্দরে তাপস-আতিক,’ প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: ‘এত কম ভোট!’ তাছাড়া দৈনিক সমকাল পত্রিকার গত মঙ্গলবার সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ খবরের শিরোনাম ছিল: ‘একাধিক ওয়ার্ডে ফল পাল্টানোর অভিযোগ।’ দৈনিক ইত্তেফাকে গত রবিবার ও সোমবার যথাক্রমে সিটি নির্বাচনের খবর ছাপা হয় যে দুই শিরোনামে তা ছিল: ‘শান্তিপূর্ণ ভোটে ভোটারের খরা’ এবং ‘আওয়ামী লীগের ভোটাররা গেল কই’। এ থেকে প্রমাণিত হয়, সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয়ী হলেও আওয়ামী লীগের বহু সমর্থক-কর্মীরাও তাদের দলের প্রার্থীদের ভোট দিতে ভোট কেন্দ্রে যাননি। তাদের হয়ত ধারণা ছিল, তারা ভোট দিতে ভোট কেন্দ্রে না গেলেও অতীতের মতো তাদের ভোট দেয়ার ব্যবস্থা দলের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই করা হবে।

আওয়ামী লীগের সমর্থক-কর্মীদের এ ধারণা কিন্তু দল হিসাবে আওয়ামী লীগের গণতন্ত্রে বিশ্বাসের প্রমাণ বহন করে না। গত মঙ্গলবার দৈনিক ইনকিলাব এর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এসম্পর্কিত সংবাদের শিরোনাম ছিল: ‘সন্তুষ্ট শেখ হাসিনা।’ প্রতিবেদনে বলা হয় : ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল ইভিএম বিতর্কের মধ্যে ভোটের দিন বিএনপি সংঘাত সংঘর্ষসহ রক্তারক্তি অঘটন ঘটায় কি না তা নিয়ে আশংকা ছিল। তাছাড়া ঢাকাস্থ কর্মরত পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের অযাচিত দৌড়ঝাপ অশনি-সংকেত বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু সব উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা দূরে ঠেলে দিয়ে উপস্থিতি কম হলেও দুই সিটিতে নৌকার মেয়র প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় শেখ হাসিনা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। একই অবস্থা দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝেও। নিজেদের মতো করে তারা বিজয়ের উল্লাস করছে। কেউ ঘুরতে গেছেন কক্সবাজার, কেউ সিলেট, কুয়াকাটা বা সুন্দরবন।

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, ইভিএম নিয়ে বিএনপি যে ধরনের প্রশ্ন তুলেছিল ও অপপ্রচার চালিয়েছিল তার উৎকৃষ্ট জবাব নির্বাচনের ফলাফল। বিদেশি দূতাবাসগুলোও নানা প্রশ্ন তুলেছিল। এখন তাদের মুখও চুপ। আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, ইভিএম-এ নির্বাচন করাটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। জনমনেও নানা প্রশ্ন ছিল। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে সিটি নির্বাচন নিয়ে যে আশঙ্কা ছিল তার কোনটাই বাস্তবে সংঘটিত না হওয়ায় শেখ হাসিনা ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের ফলাফল অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তা জনসম্মুখে প্রকাশও করেছেন।

এসবের পরও যে কথা থাকে তাহলো ভোটকেন্দ্রে অতি কমসংখ্যক ভোটারের যাওয়া। এর অর্থ হলো ভোটারদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোট হওয়া সম্পর্কে আস্থাহীনতা। এটাই ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের সর্বশেষ বাস্তব প্রমাণ। আসলে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন যে সুষ্ঠু ও সার্থক নির্বাচন হতে পারে, তা এমনকি নির্বাচন কমিশনের কর্মীরাও বিশ্বাস করেন না। শুধু ইসি (নির্বাচন কমিশন) কর্মীরাই নন, এই সেদিনই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)ও বলেছেন এরকম নির্বাচন চাইনি।

অর্থাৎ এ ধরনের একটা নির্বাচন যেখানে মাত্র ১৫-১৭% ভোটার ভোট দেবে, বাস্তবে আগ্রহ প্রকাশ করেন, তার সাথে প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা কর্মচারী হওয়ার কারণে থাকতে বাধ্য হন তারাও যে এধরনের জনসমর্থনশূন্য নির্বাচনের সাথে জড়িত না থেকে পারেন না, সে কারণে তারাও যে এ ধরনের ভোটারবিহীন নির্বাচনের সাথে জড়িত থাকতে বাধ্য হন, এটা তাদের জন্যও দুঃখজনক। কারণ তারা শুধুমাত্র প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী হওয়ায় কারণে জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনে কাজ করতে বাধ্য হন।

এসব কথার অর্থ হলো, শুধুমাত্র একটি (সরকারি) রাজনৈতিক দলের স্বার্থের কারণে তাদেরও এমন এক নির্বাচনে কাজ করতে হয়, যার প্রতি জনগণের কোনো আস্থা নেই। অর্থাৎ এ ধরনের ভোটারদের শুধু অধিকাংশের নয়, ৮০% শতাংশেরও অধিকাংশের আস্থাশূন্য একটি রাজনৈতিক দলের স্বার্থে শুধুমাত্র প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী হওয়ার কারণে তাদের এ ধরনের জনগণের আস্থাশূন্য একটি নির্বাচনে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।

ইসি সচিব (নির্বাচন কমিশন সচিব) এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ ধরনের জনগণের আস্থাশূন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য হওয়ায় এব্যাপারে তাদের ক্ষোভ ইতোমধ্যেই প্রকাশ করেছেন। এবার এসব প্রতিষ্ঠানের সহিত জড়িত অন্যরাও তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করাতে প্রমাণিত হয়, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার শুধু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকেই ক্ষেপিয়ে তুলেননি, যারা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী হওয়ার কারণে এসব অনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে বাধ্য হয়েছেন এবার তাদেরকেও ক্ষেপিয়ে তুলেছেন। তাই ইসি সচিব, সিইসি, বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তাও শেষ পর্যন্ত একটি অন্যায় কাজে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হওয়াতে তাদের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

আসলে যারা প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে নির্বাচন উপলক্ষে শাসক দলের চাপের মুখে বিভিন্ন অনৈতিক ও অন্যায় কাজে অংশগ্রহণে বাধ্য হন, তারাও এদেশেরই নাগরিক এবং এদেশের নাগরিক হওয়ার কারণে তারা এদেশের জনগণের মন-মানসিকতা বোঝেন না, এটা হতেই পারে না। তাই অনিচ্ছা সত্তে¡ও প্রশাসনে থাকার কারণে শাসক দলের চাপের মুখে এমন সব কাজে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হন, যা তাদের আত্মসম্মানবোধে আঘাত করে।

এসব কোনো সমস্যাই থাকতো না, যদি শাসক দল আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সক্রিয় থাকতো, তাহলে জনগণের আন্তরিক ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে, এমন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারতো জনগণকে। যদি শাসক দল আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সক্রিয় থাকতো, তাহলে তারা যেমন নিজেদের দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থে প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারতো না, তেমনি পারতো না দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে ঠুনকো অভিযোগে কারাবন্দি করে তাঁকে সুষ্ঠু চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে। যে বেগম খালেদা জিয়া দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন থাকা অবস্থায় একাধিকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করেন, তাঁকে শুধুমাত্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে ঠুনকো অজুহাতে কারাবন্দি করে রেখে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চেষ্টা করছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। সেই সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যারা তাদের মনে রাখতে হবে, ক্ষুদ্র পার্থিব স্বার্থে তারা আজ এ ধরনের অন্যায় অনৈতিক কাজে লিপ্ত হলেও তাদের এ ধরনের অপকর্মের ক্ষমতা একদিন না একদিন রহিত হতে বাধ্য। কারণ এ দুনিয়ায় কেউ অমর নয়। একদিন না একদিন প্রত্যেককে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে এবং এমন এক পবিত্র সর্বশক্তিমান সত্তার কাছে যেতে হবে, যাঁর বিচার থেকে কেউ রেহাই পাব না, পেতে পারবে না।

সুতরাং দু’দিনের এ দুনিয়ায় সাময়িক শক্তির দম্ভে মত্ত হয়ে অন্যায়, অনৈতিক অপকর্ম থেকে বিরত হয়ে বর্তমান সরকারের নেতৃবৃন্দ সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তুচ্ছ অজুহাতে বন্দি রেখে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার মতো অন্যায়, অপকর্ম থেকে যত শীঘ্র বিরত হন এবং ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে দেশ ও মানবতার কল্যাণে মনোযোগী হন ততই দেশ ও জাতিসহ তাদের নিজেদের জন্যও মঙ্গল। -দৈনিক ইনকিলাব

আপনার মতামত লিখুন :