করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে ইন্দোনেশিয়ায় মারা যাচ্ছে শত শত শিশু


প্রকাশিত : ২৮ জুলাই ২০২১

ইন্দোনেশিয়ার শিশু চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্যানুসারে, দেশটিতে দৈনিক নতুন করে যতজনের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়ছে, তাদের সাড়ে ১২ শতাংশই হলো শিশু। এশিয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের নতুন কেন্দ্রভূমি ইন্দোনেশিয়ায় সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে শত শত শিশু মারা গেছে। অকালে মৃত্যুর শিকার এ শিশুদের অনেকের বয়স ছিল পাঁচ বছরেরও কম। এত কম বয়সী শিশুদের কোভিডে মৃত্যুর এ হার অন্যান্য দেশের চাইতে অনেক বেশি। যার ফলে শিশুরা কোভিডের কারণে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয় চিকিৎসকদের এমন দাবিও চ্যালেঞ্জের মুখে।

চলতি মাসে প্রতি সপ্তাহে ১০০’র বেশি শিশুর জীবন কেড়েছে সর্বনাশা কোভিড-১৯। ইন্দোনেশিয়ায় সংক্রমিতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বেড়ে চলার সময়েই ঘটছে এ মৃত্যুগুলো। আর সকল বয়সী মানুষের মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলায় তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছেন ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। মহামারি মোকাবিলায় প্রস্তুতির অভাব এবং কচ্ছপগতির তৎপরতার অভিযোগ উঠছে তাদের বিরুদ্ধে। ইন্দোনেশিয়ান পেডিয়াট্রিক সোসাইটির প্রধান ডা. আমান ভক্তি পুলুঙ্গান বলেন, “শিশু মৃত্যুতে আমাদের দেশ বিশ্বে সর্বোচ্চ অবস্থানে। তাই প্রশ্ন উঠতেই পারে; কেন আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য সেরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারছি না?” ইন্দোনেশিয়ায় সংক্রমণের মূল উৎস এখন সার্স কোভ-২ ভাইরাসের ডেল্টা ভেরিয়েন্ট। সাম্প্রতিক সময়ে এই ধরনটি সমগ্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ডেল্টা বিস্তারের সাথে তাল মিলিয়ে বেড়েছে শিশু মৃত্যুর হৃদয়বিদারক ঘটনা ।

তবে সবচেয়ে শঙ্কার কথা, এ অঞ্চলের অধিকাংশ দেশেই টিকাকরণের হার কম হওয়ায় ইন্দোনেশিয়াসহ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ভিয়েতনামেও রেকর্ড মাত্রায় সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। কম টিকাহারের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার ঘনত্ব। বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ জনসংখ্যার এ দেশটি চলতি মাসেই দৈনিক শনাক্তের সংখ্যায় ভারত ও ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে যায়। ফলে শুধু এশিয়া নয়, পুরো বিশ্বের মহামারির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। গত শুক্রবারে দেশটির সরকার ৫০ হাজার নতুন সংক্রমণ শনাক্তসহ ১,৫৫৬ জনের মৃত্যুর তথ্য দেয়। এ অবস্থায় ইন্দোনেশিয়ার শিশু চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্যানুসারে, দেশটিতে দৈনিক নতুন করে যতজনের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়ছে, তাদের সাড়ে ১২ শতাংশই হলো শিশু।

পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. আমান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে শিশুদের দৈনিক সংক্রমণের ঘটনা গত মাসের চাইতেও বেড়েছে। গত ১২ জুলাই থেকে শুরু হওয়া সপ্তাহে ১৫০ জন শিশু মারা যায়, এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে মৃতদের অর্ধেকের বয়স পাঁচ বছরের কম বলেও তিনি উল্লেখ করেন। সরকারি হিসাবে ইন্দোনেশিয়ায় এপর্যন্ত ৮৩ হাজার জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা টেস্টের পরিমাণ কম হওয়ায়, রোগটির কবলে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা অনেকগুণ বেশি। অনেক সমালোচকের মতে, চলতি বছরের শুরুর দিকে ভারতে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির পরও ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সরাসরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেননি, এবং তাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে ভাইরাসের বিস্তার ঘটতে দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে সিঙ্গাপুরের রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষণা ফেলো অ্যালেক্সান্ডার রেমন্ড আরিফিয়ান্টো বলেন, “শুরু থেকেই ইন্দোনেশিয়ার সরকার মহামারিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। এমনকি মহামারি মোকাবিলার সঠিক কৌশল জানা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শেও কান দেওয়া হয়নি।” সমালোচনার মুখে গত রোববার জনসমাগম ও বাণিজ্যের ওপর বাড়তি কিছু কড়াকড়ি আরোপ করেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। তবে একইসঙ্গে প্রচলিত বাজারগুলোকে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা রাখার সিদ্ধান্ত দেন।  গত রোববার জোকো বলেন, “ঈশ্বরের অনুগ্রহ থাকলে একসঙ্গে সকলে মিলে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আমরা কোভিড-১৯ মুক্ত হব। তখন আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারবে।”

সাবেক ব্যবসায়ী জোকো শুরু থেকেই কঠোর লকডাউনের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কায় তা কার্যকরে কালক্ষেপণ করেছেন। সংক্রমণের সংখ্যা কমলে বিধিনিষেধ শিথিল করার কথাও ইতঃপূর্বে জানান তিনি। প্রেসিডেন্টের এমন বার্তায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সন্তুষ্ট নন মোটেও। ডা. আমান জানান, মহামারি হানা দেওয়ার পর থেকে দেশটিতে ১৮ বছরের কম বয়সী ৮০০ শিশু মারা গেছে শুধু সরকারি হিসাবেই। তবে বেশিরভাগ মৃত্যুই ঘটেছে গত মাস থেকে। শিশুদের সুরক্ষায় কাজ করা অলাভজনক সংস্থা- সেভ দ্য চিলড্রেনের এশীয় শাখার স্বাস্থ্য পরামর্শক ডা. ইয়াসির আরাফাত বলেন, “চলমান মহামারিতে এতদিন শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যাটি তুলনামূলক কম হওয়ায় গোপনে ছিল। সে অবস্থা এখন বদলে গেছে।”

“এখন ইন্দোনেশিয়ার মতো কিছু দেশেই যে শুধু রেকর্ড মাত্রায় শিশুমৃত্যু ঘটছে তাই নয়, একইসঙ্গে আমরা প্রচলিত রোগের বিরুদ্ধে শিশুদের টিকা দেওয়ার অভাবও লক্ষ্য করছি। শিশুরা সুষম পুষ্টি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে, অথচ তাদের বেড়ে ওঠা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য এমন পুষ্টি ও টিকাকরণ অপরিহার্য। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের নড়েচড়ে বসা দরকার,” যোগ করেন আরাফাত। অন্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও একমত পোষণ করে বলছেন, কোভিডে শিশু মৃত্যুর পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। অনেক শিশু পূর্ব শারীরিক সমস্যা ও রোগ যেমন; ডায়াবেটিস, অপুষ্টি, হৃদরোগের কারণে কোভিড মোকাবিলায় দুর্বল হয়ে পড়ছে বলে জানান তারা।

আবার ইন্দোনেশিয়ায় টিকাকরণের কম হারকেও তারা একটি প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা প্রজেক্ট- এর তথ্যানুসারে, মাত্র ১৬ শতাংশ ইন্দোনেশীয় নাগরিক টিকার এক ডোজ পেয়েছেন, আর দুই ডোজ পেয়েছেন মাত্র ৬ শতাংশ। অন্যান্য দেশের মতোই ইন্দোনেশিয়াতে ১২ বছরের কম বয়সীদের টিকা দেওয়া হচ্ছে না। অতিসম্প্রতি অবশ্য ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে টিকাকরণ শুরু হয়েছে। কিন্তু, এই দেরির ফলে পারিবারিক ও সামাজিক সংক্রমণে টিকাহীন শিশুদের মধ্যে মারাত্মক আকার লাভ করে কোভিড-১৯ এর বিস্তার।

প্রতিনিয়ত সংক্রমণ বাড়তে থাকায় গুরুতর অসুস্থ রোগীর ভিড়ে হাসপাতালগুলো উপচে পড়ছে। নেই তিল ধারণের জায়গা। হাসপাতালের বারান্দাসহ বাইরে তাঁবু খাটিয়ে জরুরি ওয়ার্ড চালু করতে হচ্ছে। এই অবস্থায় সিংহভাগ হাসপাতালেরই শিশুদের জন্য স্বতন্ত্র কোভিড ওয়ার্ড চালুর সক্ষমতা নেই। ডা. আমান প্রশ্ন রাখেন, “শিশুরা অসুস্থ হলে তাদের কোথায় নিয়ে যাবেন? জরুরি চিকিৎসার বিভাগে? সে আশা করে লাভ নেই, কারণ প্রতিটি জরুরি ওয়ার্ড পূর্ণবয়স্ক রোগীতে ভর্তি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা জরুরি বিভাগে যাওয়ার জন্য রোগীদের টানা কয়েকদিন অপেক্ষা করতে দেখছি। শিশুরা এর মধ্যে দিয়ে কীভাবে চিকিৎসা পাবে?”

তাছাড়া, হাসপাতালে ধারণক্ষমতা না থাকায় পূর্ণবয়স্ক রোগীদের দুই-তৃতীয়াংশ বর্তমানে বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন, একারণেও শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে গেছে বলে জানান ইন্দোনেশিয়ার অলাভজনক স্বাস্থ্য সেবা প্রকল্প- হোপ- এর নির্বাহী পরিচালক ঈধী রাহমাত। তিনি জানান, প্রথা অনুসারে জন্মের পর আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা নবজাত শিশুকে দেখতে আসেন। তাই নবজাতকরাও ঝুঁকিমুক্ত নয়। “কিছু নবজাতক হাসপাতাল থেকে কোভিড-১৯ মুক্ত সনদ নিয়ে বাড়ি ফেরার পর আত্মীয় ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এমন পরিণতি মেনে নেওয়া যায় না,” যোগ করেন ঈধী।

ডা. আমানের পরামর্শ জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করলে শিশুদের রক্ষা করা সহজ হবে। “প্রাপ্তবয়স্কদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। তারাই সবচেয়ে অবাধ্য আচরণ করেন। অনেক সময় মাস্কও পরতে চান না। শিশুদের নিয়ে ভিড়পূর্ণ স্থানে যান। তাই প্রাপ্তবয়স্করা সচেতন হলে শিশুদের মৃত্যু কমে আসতে পারে।”

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

আপনার মতামত লিখুন :

এই বিভাগের সর্বশেষ