গরীবরা এক ডোজও পাচ্ছে না, অথচ ধনী দেশগুলো টিকা ফেলে দিচ্ছে

প্রকাশিত : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

কোভিডের টিকা আবিষ্কার হবার পর থেকেই বিশ্বের ধনী দেশগুলো নিজেদের জন্য বিপুল পরিমাণ টিকা কিনে মজুত করে রেখেছিল- যার পরিমাণ তাদের প্রয়োজনের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। আশংকা করা হচ্ছে, এর এক বিরাট অংশই হয়তো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ফেলে দিতে হবে। টিকার ক্ষেত্রে পৃথিবীতে এখন যে অসাম্য পরিসংখ্যানে ফুটে উঠেছে, তা বিশাল। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি লোক এখনো এক ডোজ টিকাও পান নি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, পৃথিবীতে যত কোভিড টিকা উৎপাদিত হয়েছে তার ৭৫ শতাংশই গেছে মাত্র ১০টি দেশে। ইকনোমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট হিসেব করে দেখেছে – এখন পর্যন্ত উৎপাদিত ভ্যাকসিনের অর্ধেকই গেছে পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশের কাছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোতে টিকা দেয়া হয়েছে দরিদ্র দেশগুলোর চাইতে ১০০ গুণ বেশি। জুন মাসে জি-সেভেন গোষ্ঠীর সাতটি দেশ- কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকার করে যে, আগামী এক বছরে দরিদ্র দেশগুলোকে ১০০ কোটি ডোজ টিকা দান করা হবে। অথচ সেই টিকা এখনো দেওয়া হয়নি।

যুক্তরাজ্য অঙ্গীকার করেছিল তারা দেবে ১০ কোটি টিকা, এখন পর্যন্ত তারা ৯০ লক্ষেরও কম দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছিলেন তিনি ৫৮ কোটি টিকা দান করবেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত দিয়েছে ১৪ কোটি। আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ২৫ কোটি টিকা দেবার কথা বললেও এখন পর্যন্ত সরবরাহ করেছে তার মাত্র ৮ শতাংশ। অনেক মধ্য আয়ের দেশ কোভ্যাক্স থেকে টিকা কিনেছে- যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমর্থিত একটি উদ্যোগ। কোভ্যাক্স মধ্য আয়ের দেশগুলোর কাছে কম দামে টিকা বিক্রি করবে, এবং দরিদ্র দেশগুলোকে বিনামূল্যে দান হিসেবে দেবে – এটাই ছিল পরিকল্পনা।

২০২১ সালে কোভ্যাক্সের পরিকল্পনা ছিল ২০০ কোটি টিকা সরবরাহ করা, যা আসার কথা ভারত থেকে। কিন্তু সেখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মক চেহারা নেবার পর ভারত সরকার টিকা রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। টিকা সরবরাহে এই গুরুতর বিঘ্নের পর কোভ্যাক্স মূলত ধনী দেশগুলোর দানের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু সরবরাহের গতি অত্যন্ত ধীর। কোভ্যক্সের টিকা পাওয়া কিছু দেশ এখনো তাদের জনসংখ্যার ২ শতাংশকেও টিকা দিতে পারেনি।

কোভ্যাক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওরেলিয়া এনগুয়েন বলছেন, ‘বর্তমানে খুব কম পরিমাণে টিকা শেয়ার হচ্ছে, এবং তাদের যে সময় সীমা অর্থাৎ এক্সপায়ারি ডেটের মধ্যে ব্যবহার করতে হবে- সেই সময়সীমাটাও ছোট’। এ কারণে টিকাগুলো কোনো দেশে পাঠানোর কাজটা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। এয়ারফিনিটি নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, এটা সারা বিশ্বের সরবরাহ সমস্যা নয়। ধনী দেশগুলো তাদের হাতে অতিরিক্ত টিকা মজুত করে রাখছে। টিকা উৎপাদদনকারীরা এখন প্রতিমাসে দেড়শ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করছে, এবং এ বছরের শেষ নাগাদ ১১০০ কোটি টিকা উৎপাদিত হবে।

এয়ারফিনিটির গবেষক ড. ম্যাট লিনলি বলছেন, ‘তারা বিপুল পরিমাণ টিকা উৎপাদন করছে এবং গত তিন-চার মাসে উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে’। এর ফলে সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর হাতে ১২০ কোটি ডোজ টিকা থাকবে যা- বুস্টার ডোজ হিসেবে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও, তাদের আসলে তার দরকার নেই। ড. লিনলি বলছেন, এই টিকার প্রায় এক পঞ্চমাংশ, ২৪ কোটি ১০ লাখ টিকা, এখন ফেলে দেবার ঝুঁকির মুখে পড়েছে, যদি না তাদের অতি শীঘ্র অন্য দেশগুলোকে দান করা হয়। এমন সম্ভাবনা আছে যে দরিদ্র দেশগুলো এসব টিকা গ্রহণ করবে না- যদি না এগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ হবার আগে অন্তত দুই মাস সময় থাকে।

ড. লিনলি বলছেন, ‘ধনী দেশগুলো লোভের কারণে এত টিকা কিনে রেখেছিল এটা আমি মনে করি না, আসলে কোন টিকায় কাজ হবে তা তখন তারা জানতো না, ফলে তারা কয়েক রকম টিকা কিনতে বাধ্য হয়েছিল’। তবে এয়ারফিনিটি বলছে, এখন টিকা উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি যেরকম, তাতে অতিরিক্ত টিকা মজুত করে রাখার কোন দারকার নেই। বরং তারা সেই অতিরিক্ত টিকা অন্য দেশকে দান করে দিতে পারে। কিন্তু কিছু দেশ আবার টিকা দান করে দিতে চাইছে না এর পেছনে রাজনৈতিক চাপও একটা কারণ। সরকার টিকা দান করে দিচ্ছে এটা দেখে ভোটারদের একটি অংশ নাখোশ হতে পারে, কারণ অনেকে মনে করে এ টিকা দেশে দরকার হতে পারে।

কোভ্যাক্সের অরেলিয়া এনগুয়েন বলছেন, সরকার ছাড়া অন্যদেরও এ ব্যাপারে দায়িত্ব আছে। আমরা চাই টিকা উৎপাদনকারীরা কোভ্যাক্সের কাছে যে অঙ্গীকার করেছে তা পূরণ করুক। যেসব দেশ ইতোমধ্যেই যথেষ্ট টিকা পেয়ে গেছে, তাদের সাথে করা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির চাইতে তাদের উচিত কোভ্যাক্সকে অগ্রাধিকার দেয়া। তিনি প্রশ্ন তুলছেন, উৎপাদনকারীরা যদি প্রতি মাসে দেড়শ কোটি টিকা উৎপাদন করে তাহলে দরিদ্র দেশগুলোতে এত কম টিকা পৌঁছাচ্ছে কেন? তার মতে, যেখানে কোভ্যাক্সের প্রয়োজন বেশি, সেখানে সরকারগুলোর উচিত তাদের জন্য পথ ছেড়ে দেওয়া, যাতে তারা দ্রুত টিকা পেতে পারেন।

 

আপনার মতামত লিখুন :