বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাক, প্রজন্মান্তর। সাইদুর রহমান

প্রকাশিত : ১৭ মার্চ ২০২০

জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষণজন্মা পুরুষ নয়। উনার জীবদ্দশায় ক্ষণকালীন চিন্তাচেতনা  ছিলনা। বঙ্গবন্ধুর বিচরণ ছিল বিশ্ব রাজনৈতিতে। তিনি ছিলেন ছেষট্টি থেকে বাহান্ন, আবার একাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত বাঙালী জাতীয়তাবাদী মুক্তিকামী মানুষের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। তাঁকে ক্ষণিকের ফ্রেমে বেঁধে রাখার স্বল্পকালীন চিন্তা ভাবনা হবে জাতীর জন্য আত্বঘাতি। তাঁর চিন্তাচেতনা ছিল বিশ্বের নির্যাতিত নিপিড়ীত মানুষের পক্ষে। বঙ্গবন্ধুর মত নেতা যুগে না শতবর্ষেও জন্মায় না। তাই হয়তোবা সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফজল বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বর্ননা করতে গিয়ে লিখেছিলেন ” শালপ্রাংশু দেহ শেখ মুজিবের মুখের দিকে চেয়ে থাকা যায় অনেকক্ষণ ধরে। ঐ মুখে কোন রুক্ষতা কি কর্কশতার চিহ্ন ছিল না । তাঁর হাসি ছিল অপূর্ব,  অননুকরণীয়। এমন হাসি অন্য কারও মুখে দেখেছি বলে মনে পড়ে না । “
                বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে আজ পযর্ন্ত  বাংলাদেশ এমন নেতার জন্ম দেখেনি। আর বিশ্বের মানুষ ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ,  ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ ছাড়া কয়জন নেতা তাঁর কাছাকাছি দেখেছেন। বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে চিনেছেন বঙ্গবন্ধুর দীপ্ত কন্ঠের আলোকে। তিনি বিশ্ব রাজনৈতির মঞ্চে ছিলেন নীতি ও আদর্শের প্রতীক। তাঁর রাজনৈতি সুদূর প্রসারিত চিন্তাচেতনায় বিশ্বের অনেক নেতাই ঈষাণ্বীত হয়েছিলেন। দেশী ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ঘৃণ্য পরিকল্পনায় ; বিশ্বের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটে বাংলার বুকে।
           বঙ্গবন্ধুর মতো বিশ্বনন্দিত নেতাকে বাঙালি জাতি হৃদয়ের স্হান দিতে চায় হাজার বছর নয়,  লক্ষ বছর নয় পৃথিবী ধ্বংসের আগ পযর্ন্ত। তাঁকে ভাস্কর্যে, অফিস, আদালতে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাংগানো স্বল্পকালীন চিন্তার বাইরে দেখতে চায় পরবর্তী প্রজন্ম। মুজিব শতবর্ষের ক্ষনসময় গণনা, দেশ ব্যাপী আলোক সজ্জা, রাজধানীকে নববধূ রুপে সাজানো ,   সারা দেশে ১৫০ টি কাউন্টডাউন ঘড়ি বসানো, আকাশ বিদীর্ণ করা আতশবাজী, বিশ্বের শত নেতাদের আগমন ক্ষণকালীন চিন্তার বহিঃপ্রকাশের নামান্তর। বঙ্গবন্ধু বিশ্বনন্দিত নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের উৎসব। দিবসটি পালিতও হবে বিশ্বজুড়ে, বছরজুড়ে। আয়োজনে শামিল হয়েছে ইউনেস্কোও। কারণ বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের নেতা ছিলেন না, ছিলেন  বিশ্বের নিপিড়ীত  মানুষের নেতা।
                   বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষকে বিশ্ব দরবারে শুধু পরিচিত করাতে শতবর্ষ উৎযাপনের উদ্যেশ্য সীমাবন্ধ থাকলে হবেনা। তাঁর রাজনেতিক মতাদর্শ ও লালিত স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে।
 শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশের অনেক দেশপ্রেমিক নেতার নাম কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে কিংবা যাচ্ছে। এ মহাদেশের ইতিহাস কালের সাক্ষী। নবাব সিরাজ উদ দৌলা, শেরে  বাংলা একে এম ফজলুল হক,  হোসেন শহীদ সোহরাওর্দী  এ মহাদেশের রাজনৈতির আইকন ছিলেন। তাঁরা দেশ ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন আন্দোলন ও সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁদের মতাদর্শ এবং বলিষ্ঠ রাজনেতিক নেতৃত্বগুণের কথা বাংলার মানুষ ভূলতে বসেছে। অথচ এই তিন নেতার কেউ জীবন দিয়ে আবার কেউ জীবনের সমস্ত চাওয়া পাওয়াকে বিসর্জন দিয়ে মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করে গেছেন।  নবাব সিরাজ – উদ – দৌলা কে ১৯৫৭ সালে মেরে ফেলা হয়েছে। তারপর ব্রিটিশরা ২০০ বছর রাজত্ব করেছেন। জাতীর বীর নবাব সিরাজ উদ দৌলা মারা গেছেন ২৬৩ বছর আগে। নবাবের অবদানের কথা নতুন প্রজন্মের কয়জনের স্মৃতিতে গাঁথা আছে?
 শেরে বাংলা একে এম ফজলুল হক বাংলার বাঘ ছিলেন। নিপিড়ীত,  শোষিত মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন।
কৃষকের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র বইয়ের ২২ পৃষ্ঠায় পরিস্কার লিখেছেন, শেরে বাংলা বিপক্ষে বক্তৃতা দিয়ে গিয়ে জনগণের মার খেতে হয়েছে। শেরে বাংলা বাঙালীদের মনে দাগ কেটেছিল ঠিকই কিন্তু প্রজন্মান্তর সেটা ঠিকে থাকবেনা । শেরে বাংলা মারা গেছেন ৬৩ বছর   আগে ( মৃত্যু ১৯৬২) । তাঁর মতাদর্শ কয়জন বাঙালী বুকে লালন করে?
              তারপর আসি,  একজন প্রতিভাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব,   হোসেন শহীদ সোহরাওর্দী। তিনি  ছিলেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র। তাঁর রাজনেতিক মতাদর্শকে বঙ্গবন্ধু অনুসরণ করতেন। তাঁকে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক শিক্ষা গুরু হিসাবে মানতেন। অসমাপ্ত আত্বজীবনী বইয়ের ২৮ পৃষ্ঠার শেষের অংশে বঙ্গবন্ধু নিজে বলেছেন, আমরা হোসেন শহীদ সোহরাওর্দী সাহেবের  ভক্ত ছিলাম। অথচ তিনি মারা গেছেন ৬২ বছর আগে (মৃত্যু ১৯৬৩)  । যদিও তাঁর মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক আছে। তাঁকে কতটুকু আমরা মনে রাখতে পারছি, তা জাতির বিবেকের কাছে আজ আমার প্রশ্ন?
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে, বঙ্গবন্ধুর লেখনীতে  শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী এই নেতার কথা উল্লেখ করেছেন অসংখ্যবার।
            দলের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, ক্ষমতার বেড়াজালে সীমাবন্ধ। কিন্তু দলের বা সংগঠনের ক্ষমতার কোন সীমাবন্ধতা থাকেনা । আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টানা তৃতীয় মেয়াদে। আজ বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ পালনে সবাই কালের সাক্ষী হতে চায়। কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর প্রকৃত ইতিহাস এবং জাতির পিতা উপাধীটাও দলীয় নেতাদের বাইরে তেমন কেউ উচ্চারন করতো না। স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রেরণাকারী স্লোগান “জয় বাংলা ” র কন্ঠও ছিল অর্ধমৃত। বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর নীতি, আদর্শ এবং ইতিহাসকে বিকৃত করার নির্লজ্জ চেষ্টা করেছে।
       তাই দলীয় ক্ষমতার ছায়াতলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে রাখা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সমানুপাতিক মতাদর্শে গঠিত দল ও অঙ্গসংগঠন গুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। আওয়ামীলীগের অঙ্গসংগঠন  গুলোকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চারণভূমিতে পরিণত করতে হবে। সাংগঠনিক নিয়মনীতির আলোকে পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের যথার্থ মূল্যায়ন করতে হবে। যতদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দল ঠিকে থাকবে,  ততদিন বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন। ততদিন
বাংলার আকাশে বাতাসে বঙ্গবন্ধুর নাম উড়বে লাল সবুজ পতাকার মতো। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে বঙ্গবন্ধুর নাম লেখা থাকবে কিনা তা ইতিহাসের পিচ্ছিল গতিপথ ভবিষ্যৎতে বলে দিবে । কিন্তু আম জনতার মনের অন্তরিক্ষে তাঁর আদর্শের স্বর্ণ কুটির তৈরী করা দীর্ঘস্থায়ী চিন্তাচেতনার অভিপ্রায় হতে পারে।
               ক্ষমতার আলোকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়ানো সম্ভব না।
                   লেখক ও কলামিস্ট : সাইদুর রহমান

আপনার মতামত লিখুন :