হাসিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেন গুলিতে চোখ হারানো নারী

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৪ আগস্ট, ২০২৫, ১১:৩৬ রাত

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি সাবেক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো পারভীন নামে এক নারী। তিনি এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে এক চোখ হারান পারভীন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তৃতীয় সাক্ষী তিনি। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন পারভীন।

সোমবার বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।

পারভীন বলেন, আমার দুই সন্তানের কাছে আমি অন্ধ মা হয়ে গেছি। আমার এই অন্ধ হওয়ার জন্য একমাত্র দোষী শেখ হাসিনা।

পারভীন সাক্ষীর ডায়াসে দাঁড়িয়ে তার জবানবন্দিতে বলেন, আমার নাম পারভীন। বয়স ২৭। আমি ঢাকার যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী এলাকায় থাকতাম। এখন বরিশালে স্বামীর বাড়িতে থাকি। ঢাকায় থাকা অবস্থায় আমি দিনমজুরের কাজ করতাম। ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই প্রতিদিনের মতো জুরাইনে ৫টা পর্যন্ত কাজ করে লেগুনা স্ট্যান্ডে আসি। এখানে কোনো গাড়ি না পেয়ে হেঁটে রওনা হই। যাত্রাবাড়ী এসে দেখি অনেক মানুষ আহত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে ১৮/১৯ বছরের একটা ছেলেকে পড়ে থাকতে দেখি। ছেলেটি চিৎকার করছিল আর তার সারা শরীর রক্তাক্ত ছিল। তার দুই চোখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। ছেলেটির গলায় একটা আইডি কার্ড ছিল। ছেলেটি শুধু বলে আমাকে বাঁচান। একপর্যায়ে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আমাকে ধরে আমার ঘাড়ে মাথা দেয়। আমি রিকশা খুঁজতে থাকি তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।

এসময় ১৪-১৫ জন পুলিশ মারমুখী হয়ে ওই ছেলেকে লক্ষ্য করে গুলি করে। ওই গুলি ছেলেটার পিঠে লাগে। আমি বাম হাত তুলে গুলি না করতে অনুরোধ করি। তখন একজন পুলিশ আমার বাম চোখে গুলি করে। এরপর তিনজন পুলিশ আমার তলপেটসহ কয়েক জায়গায় গুলি করে। এসময় আমার চোখ দিয়ে ফুল্কি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। রক্তে রাস্তা ভেসে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে ছেলেটাকে নিয়ে আমি রাস্তায় পড়ে যাই। এসময় ছেলেটা একটা নিশ্বাস নেয়। মনে হচ্ছিল ওইসময় ছেলেটি মারা যায়। পরে লোকজন এসে বলে ছেলেটি তো মারা গেছে, মেয়েটি জীবিত আছে। একটি সিএনজিতে আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার পর গড়িমসি করা হয় এবং বলা হয়, এটা তো পুলিশ কেস। তখন লোকজন বলে তাহলে কি উনি মারা যাবে?

এসময় একজন নার্স এসে বলে, আপনার ড্রপ লাগবে, ২৫০ টাকা আছে? আমি বলি, আমার কাছে কোনো টাকা নেই। তখন অন্য একজন মহিলা ২৫০ টাকা দিয়ে একটি ড্রপ কিনে দেয়। পরে আর কোনো চিকিৎসা না করে ডাক্তাররা চলে যায়।

আমার এ অবস্থার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিয়ে পরের দিন সকালে আমার স্বামী বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছায়। তখন ডাক্তাররা তাকে বলে আপনার স্ত্রীর অপারেশনের জন্য কিছু জিনিস কেনা লাগবে। তখন আমার স্বামী কিছু আসবাবপত্র ও আমার কানের দুল বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে। পরে আমার অপারেশন হয় ও আমার চোখ থেকে তিনটি গুলি বের করা হয়। এ ছাড়া ডাক্তাররা দেখেন আরও গুলি ভেতরে রয়েছে। পরে আমাকে চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে যেতে বলা হয় এবং আমার স্বামী আমাকে চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ভর্তি হওয়ার পরও আমার অপারেশন হয়নি।

পারভীন বলেন, পাঁচ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার অপারেশন হয়। এখনো আমার তলপেটে অনেক গুলি আছে, যা বের করা সম্ভব হয়নি। আমি এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমি ন্যায়বিচার পেতে আপনাদের কাছে এসেছি। আমার একটি চোখ (বাম) ড্যামেজ হয়ে গেছে চিকিৎসায় অবহেলার কারণে। এ ছাড়া আমার ডান চোখেও কম দেখি। আমার দুই সন্তানের কাছে আমি এখন অন্ধ মা হয়ে গেছি। অন্ধ হওয়ার জন্য একমাত্র দোষী শেখ হাসিনা। আমার দুই সন্তানও চায় তার মায়ের অন্ধত্বের বিচার হোক। তাই আমি আমার অন্ধত্ব ও শহীদদের এবং আহতদের জন্য বিচার চাই। শেখ হাসিনা হলো পুলিশের মা-বাবা। তার নির্দেশে পুলিশ গুলি করেছে। তার নির্দেশ ব্যতীত পুলিশ এভাবে গুলি করতে পারে না।

তার সাক্ষ্যগ্রহণের পর জেরা করা হয়। জেরা করেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। এরপর ট্রাইব্যুনাল পরবর্তী সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ছয় আগস্ট দিন ধার্য করেন।

Link copied!