শীতে পাটিকরদের দুর্দিন, মানবেতর জীবনযাপন

প্রকাশিত : ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ঝালকাঠি প্রতিনিধি: ঝালকাঠির রাজাপুরের হাইলাকাঠি, নাপিতেরহাট ও পুখুরীজানা এ ৩ গ্রামের পাটিকরদের মানবদের জীবনযাপন করছেন। শীত মৌসুমে শীতলপাটির কদর না থাকায় কারিগরদের চরম দুর্দিন চলছে। একটা সময় ছিল যখন গ্রামের বাড়িতে অতিথি এলে বসতে দেয়া হতো পাটিতে। গৃহকর্তার বসার জন্যও ছিলো বিশেষ ধরনের পাটি।বর্তমানে হিন্দুদের বিয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ শীতলপাটি। গরমকালে শীতলপাটির কদর একটু বেশিই। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের দুপুওে এউ পাটি দেহ-মনে আনে শীতলতার প্রশান্তি।

ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পূর্ব দিকে হাইলাকাঠি ও পুখুরীজানা নামে দুটি শীতলপাটির গ্রাম অবস্থিত। সেখানে ৮৪টি পরিবার আজও পাটি শিল্পকে তাদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন হিসাবে আকড়ে রয়েছে। এখানকার তৈরী শীতলপাটি পাইকারদেও হাত ঘুওে চলে যায় ঢাকা, বরিশাল, সিলেট ,খুলনা ও যশোরের বিভিন্ন হাট-বাজারে। রপ্তানিপণ্য হিসাবে কোন স্বীকৃতি না পেলেও  শৌখিন ব্যবসায়ী , বেড়াতে অসা অতিথিদের মাধ্যমে শীতলটাটি যাচ্ছে কলকাতা, মধ্যপ্রাচ্য, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে। অনেকে আবার বসার ঘরের শোভা বাড়াতে নকশাকরা শীতলপাটি দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখেন। হাইলাকাঠি গ্রামের পাটিকর শীল্পি নরোত্তম পাটিকর,তপন পাটিকর,বারেক পাটিকর,ফুলটি রানী,মিনতিরানী, অলো রানী, অঞ্জনা রানী ও শীল্পি রানীসহ একাধিক পাটিকর বলেন, পাটি ও হাত পাখা তেরীর কাঁচামালের নাম পাইত্রা নামের এক প্রকার গাছ। হাইলাকাঠি ও পুখুরীজানা নামে দুটি গ্রামের পরিত্যাক্ত জমিতে এ গাছ জন্মায়।

এ গাছ ৫-৭ ফুট লম্বা হয়। প্রতি বছরে পৌষ,মাঘ,ফাল্গু ,চৈত্র ও বৈশাখ মাস পর্যন্ত এ গাছ কাঁচামাল হিসাবে কাটা হয়। এ গাছ জন্মাতে কোন খরচ নেই। শুধু পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। এলাকার জাদব, বিজয়, শুকুর,স্বপন,জান্টু,বলাই,ফেলু ও কাজেম হাওলাদারসহ ১০/১২ জন পাটিকরের ৫-৭ বিঘা করে পাইত্রার বাগান রয়েছে। বাকি পাটিকরদের খুব সামান্য করে পাইত্রা বাগান রয়েছে। ছোট বাগানের মালিদেরকে বড় বাগানের মালিকদের কাছ থেকে প্রতি এক পোন (এক পোনে ৮০টি) পাইত্রা গাছ ৩শ’ টাকা থেকে সারে ৩শ’ টাকায় ক্রয় করতে হয়। প্রথমে প্রতিটি গাছের উপরের সবুজ অংশ ছাল হিসাবে পাতলা করে আলাদা করা হয়। এটাকে বেতি বলে। সবুজ অংশের পরে দ্বিতীয়বার আবার একটি পাতলা অংশ আলাদা করা হয়। এটাকে ছোটা বলে। ছোটা গুলো রৌদে শুকিয়ে বিভিন্ন দোকানে পণ্যসামগ্রি বিক্রির সময় মোচা বাধার জন্য বিক্রি করা হয়। ৮০টি পাইত্রা গাছে দুই কেজি ছোটা হয়। ছোটার কেজি ২০ টাকা থেকে ৫০টাকা করে বিক্রি করা হয়। অপরদিকে ৮০টি পাইত্রার গাছের বেতি দিয়ে একটি পাটি তৈরী করা যায়।

পাইত্রা গাছ কাটা থেকে প্রতিটি পাটি তৈরী পর্যন্ত দুই জনের কমপক্ষে ৭-৮দিন সময় লাগে। চার হাত চওড়া ও পাঁচ হাত লম্বা একটি পাটি ৭শ’ টাকা থেকে ১৫শ’ টাকায় বিক্রি করা যায়। প্রথমে বেতী গুলো টিকসই করার জন্য ভাতের মারের ভিতরে কিছুসময় ভিজিয়ে রাখতে হয়। সেগুলো আবার কিছু সময় গরম পানিতে সিদ্ধ করতে হয়। পাটি রঙিন করার জন্য গরম পানিতে সিদ্ধ করার সময় বিভিন্ন রং দেয়া হয়। এছাড়া বেতি দিয়ে হাত পাখাও তৈরী করা হয়। গরমের সময় পাটি ও পাখার কিছুটা চাহিদা থাকলেও এই শীত মৌসুমে আদৌ কোন চাহিদা নেই। তাই অধিকাং পাটিকররা সংসার চালাতে ও পাইত্রা গাছ কিনতে আশা, সংকল্প, ব্র্যাক,গ্রামিন ব্যাংক ও ব্যুরো বাংলাদেশসহ অনেক এনজিও’র কাছ থেকে চরা সুদে ঋণ ও গ্রামের কিছু লোকের কাছ থেকে দাদনে টাকা ঋণ নিয়েছেন।

অনেকেই সংসার চালিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারছেনা। অন্য কোন পৃষ্ঠ পোষকতাও পাচ্ছেনা। তাই পাটিকরদের অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। ঐতিহ্যবাহি এ পেশাকে ধরে রাখতে  হলে সরকারের পৃষ্টপোষকতা একান্ত প্রয়োজন। হাইলাকাঠি ডহরশংকর শীতলপাটি উন্নয়ন মুলক সমবয় সমিতির সভাপতি তাপস কুমার পাটিকর জানান, সিডরের পর ২০০৮ সালে সেনাবাহিনীর আশার আলো প্রকল্পের অধিনে পাটি বুনানোর জন্য দুটি শেড নির্মান করে দেয়া হয়  এবং বেতি ভিজানোর জন্য একটি পাতিল কিনে দেয়। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে পাটিকররা কোন সাহায়্য সহযোগিতা পায়নি। প্রতি জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত পাটি বিক্রির ঢাল ছিজন বলা হয়।

এসময় শুধু পাটি তৈরীর সময়, বিক্রির সময় নয়। কারণ এসময় পাটির সঠিক মুল্য পাওয়া যায়না। তার পরেও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে কম মূল্যে পাটি বিক্রি করা হয়। তিনি আরো জানান, ঢাল ছিজনে পাটিকর পরিবারগুলো সরকারের কাছে ৬ মাসের জন্য একটি করে ভিজিডি কার্ড, সুদ মুক্ত ঋণের দাবি এবং বানিজ্যিকভাবে পাটি রপ্তানির উদ্যোগ নেয়ার ব্যবস্থা করার দাবি করছেন। তাহলে ঢাল ছিজনে পাটি তৈরীকরে মজুদ রেখে গরমের সময় সঠিক মূল্যে বিক্রি করতে পারবে। ঝালকাঠি বিসিকের প্রকল্প পরিচালক শাফাউল করিম জানান, বিসিকের পক্ষ থেকে পাটিকরদের সব ধরনের সহযোগীতা দেয়া হবে।

 

আপনার মতামত লিখুন :