ভাবতে স্বপ্ন মনে হলেও বাস্তবে তাই ঘটেছে মাত্র ১০০ টাকায় পুলিশে চাকরি

প্রকাশিত : ১১ নভেম্বর ২০২১

মাত্র ১০০ টাকায় পুলিশের চাকরি। ভাবতে স্বপ্ন মনে হলেও বাস্তবে তাই ঘটেছে গাজীপুরে এবার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায়। তদবির নয়, দালাল, দুর্নীতি নয়, শুধুমাত্র মেধার মূল্যায়নে এবার এই পদে জেলায় চাকরি পেয়েছেন ৭১ জন।

পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে রেখে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) নিয়োগকে অত্যন্ত সততা, দক্ষতা, দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছতার সাথে মাত্র ১০০ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা প্রদান সাপেক্ষে ৭১ জনকে প্রার্থীকে চূড়ান্ত প্রাথমিকভাবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রার্থী ও তাদের অভিভাবকদের কয়েকজন মাত্র ১০০ টাকায় এমন স্বচ্ছ নিয়োগ বিরল জানিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিয়োগপ্রাপ্তরা তাদের আনন্দ আর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে তাদের কাজ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।

গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আমির হোসেন জানান, চাকরি নয় সেবা এই স্লোগানকে সামনে রেখে গত ২৯ অক্টোবর গাজীপুর পুলিশ লাইনস মাঠে শুরু হয় ট্রেইনি রিক্রুট কন্সটেবল (টিআরসি) নিয়োগ পরীক্ষা। পরীক্ষায় গাজীপুর জেলার পাঁচ উপজেলাসহ গাজীপুর মহানগর এলাকা থেকে আগ্রহী প্রার্থীরা অনলাইনে আবদনসহ সরকারি কোষাগারে ১০০ টাকা ব্যাংক চালান জমা প্রদান করে অংশগ্রহণ করেন। প্রার্থীদের আবেদন শেষে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স প্রিলিমিনারি স্কিনিং করে ২ হাজার ৮৪০ জন নারী ও পুরুষ প্রার্থীকে গাজীপুর জেলার জন্য নির্বাচিত করে। পরে গাজীপুর জেলা পুলিশ লাইন্স মাঠে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) দের ১ম দিনের ইভেন্ট শারীরিক মাপ ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে ১ হাজার ৭৩ জন প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়। পরের দিন ২য় দিনের ইভেন্ট দৌড়, পুশ আপ, লং জাম্প ও হাই জাম্প পরীক্ষা শেষে ৭১৭ জন প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়।

গত ৩১ অক্টোবর ৩য় দিনের ইভেন্ট দৌড়, ড্র্যাগিং ও রোপ ক্লাইম্বিং এর মধ্য দিয়ে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) দের শারীরিক সক্ষমতা ও মাঠ পরীক্ষা শেষ হয়। মাঠ পরীক্ষা শেষে ৫৮৭ জনকে লিখিত পরীক্ষার জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করে নিয়োগ বোর্ড কমিটি।

গত ১ নভেম্বর ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) দের লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন হয় এবং ৮ নভেম্বর ১৯৮ জনের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নাম ঘোষণা করে নিয়োগ বোর্ড। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করেন নিয়োগ বোর্ড। গাজীপুর জেলায় নিয়োগযোগ্য প্রকৃত শূন্য পদের বিপরীতে সরকার কর্তৃক জারিকৃত বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি (সাধারণ, মুক্তিযোদ্ধা, আনসার ও ভিডিপি, এতিম, পোষ্য এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা) অনুসরণ করে লিখিত, মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরেরভিত্তিতে মেধাক্রম অনুযায়ী সর্বমোট ৭১ জন (সাধারণ-৫২, মুক্তিযোদ্ধা-১২, আনসার ও ভিডিপি-০১ এবং পোষ্য-০৬) জনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করে নিয়োগ বোর্ড কমিটি ফলাফল ঘোষণা করেন।

চূড়ান্ত নিয়োগপ্রাপ্ত সদস্যরা এসময় পুলিশ লাইন্স মাঠে তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। অনেকে আনন্দের আতিশয্যে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

গাজীপুরের সফিপুর এলাকার শিল্পী আক্তার। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত এই নারী বলেন, ২০০৮ সালে আমার বাবা মারা যান। আমাদের তিন ভাই দুই বোন সবাই তখন ছোট ছিলাম। আমার মা পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। তখন আমার দুই ভাই টুকটাক কাজ করত। মেঝ ভাই রুহুল আমিন আমার স্বপ্ন পূরণে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তিনি আমার পেছনে লেগে ছিলেন ভাল কিছু করার জন্য। আমার ভাইয়ের জন্য আজ আমি এ পর্যন্ত এসেছি, ভবিষ্যতে আরো দূর এগিয়ে যাব ইনশাল্লাহ।

নিয়োগ পরীক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, আত্মীয়, পরিজন, প্রতিবেশী সবাই বলছে সরকারি চাকরি টাকা ছাড়া হয় না। টাকা ছাড়া আমি যে পদে আবেদন করেছি সেই পদে নিয়োগ হয় না এমনটাই বলত সবাই। কিন্তু এখানে নিয়োগ পরীক্ষায় কোন টাকা পয়সা দিতে হয়নি, দালাল ধরতে হয়নি। ছোট বেলার স্বপ্ন ছিল পুলিশ হব, অন্যায়ের প্রতিবাদ করব। আমি যে পরিবেশে থাকি সেখানে নেশাগ্রস্ত অনেক। আমার ইচ্ছা দেশকে নেশামুক্ত করার। সাধারণভাবে এটি করা সম্ভব না কিন্তু এখন পুলিশ হয়ে সেই কাজ সহজে করতে পারব। এখন আমার ভাল লাগছে যে আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারছি।

সদর উপজেলার ভবানীপুর এলাকার জাহাঙ্গীর শেখের মেয়ে লামিয়া আক্তার। সবেমাত্র গাজীপুর মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন। নিজের অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। লামিয়া বলেন, আমার বাবা প্যারলাইজ্ড। তার কোন কিছু করার ক্ষমতা নেই। আমার ভাই আমাকে এত দূর পড়াশোনা করিয়েছেন। আমার মা ও ভাইয়ের কারণে আমি আজ এ পর্যন্ত এসেছি। সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের স্বপ্ন ছিল আমার। আর এটা বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমেই সম্ভব। এই অনুপ্রেরণা থেকেই আমার পথ চলা।

কাপাসিয়া উপজেলার পারুলিয়া গ্রামে ডাকঘরে পোস্টম্যানের কাজ করেন দিপক চন্দ্র দাস। তার ছেলে প্রকাশ চন্দ্র দাসেরও ঠাঁই হয়েছে এবারের কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায়।

প্রকাশ চন্দ্র দাস বলেন, আমার বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় আজ আমি পুলিশের চাকরি পেয়েছি। এই চাকরি পেতে আমাকে কোন ঘুষ দিতে হয়নি, এজন্য আমি অনেক আনন্দিত। সম্পূর্ণ যোগ্যতারভিত্তিতে এই চাকরি দেয়া হয়েছে। তাই এ নিয়োগকে পরিশুদ্ধ বলা চলে। এজন্য আমি পুলিশ মহাপরিদর্শক ও জেলা পুলিশ সুপারকে ধন্যবাদ জানাই।

ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) কমিটির সভাপতিত্ব করেন গাজীপুর পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ। এসময় তার সঙ্গে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স-এর পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফেরদৌসী রহমান প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া নিয়োগ কমিটিতে সদস্য হিসেবে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শরফুদ্দীন ও নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পরিত্রান তালুকদার দায়িত্ব পালন করেন।

নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি এসএম শফিউল্লাহ বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে রেখে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) নিয়োগকে অত্যন্ত সততা, দক্ষতা, দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছাতার সঙ্গে করেছি। মাত্র ১০০ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা প্রদান ৭১ জন প্রার্থীকে চূড়ান্ত প্রাথমিকভাবে নিয়োগ প্রদান করেছি।

আপনার মতামত লিখুন :