লামায় ক্ষতিগ্রস্থ ম্রোদের পাশে তরুণ জলবায়ু কর্মীরা

প্রকাশিত : ১৮ জানুয়ারি ২০২৩

বান্দরবানের লামা উপজেলায় ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের শিকার ম্রো জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের পাশে দাঁড়িয়েছে তরুণ জলবায়ু কর্মীরা।

মঙ্গলবার (১৭ই জানুয়ারি) লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের রেংয়েনপাড়া ও লাংকম কারবারী পাড়ায় বিপদাপন্ন ম্রো সম্প্রদায়ের মধ্যে শীতবস্ত্র (কম্বল), নগদ টাকা ও খাদ্য সহায়তা প্রদান করেছে পরিবেশবাদী যুব সংস্থা ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস। এ সময় আক্রান্তরা জানান, ১ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের প্রায় দেড়শ লোক দেশীয় লাঠিসোটা নিয়ে ছয়টি ছোট ছোট ট্রাকে করে রেংয়েন ম্রো পাড়ায় হামলা করে। হামলাকারীরা কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগায় এবং বাড়ীঘর লুটপাট করে। এতে তিনটি বাড়ি পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে যায়। এ পাড়ার ১১টি দরিদ্র পরিবারের মূল্যবান কাগজপত্রসহ চাল, কাপড়চোপড়, ছাগল, মুরগি, কোদাল, দা সবকিছুই লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃৃত্তরা। আরও ম্রোদের ৬ টি বাড়িতে ভাংচুর করা হয়েছে। তীব্র শীতের মধ্যে আক্রান্ত ম্রো সম্প্রায়ের মানুষেরা খাদ্যসংকটে পরে। পরিবারগুলো আতঙ্কে ও কাপড়চোপড় না থাকায় প্রচণ্ড শীতে আগুন জ্বালিয়ে রাত কাটিয়েছেন শিশুসহ অনেকে। এমন পরিস্থিতে মানবিক সংকটে থাকা মানুষের পাশে এগিয়ে আসে ইয়ুথনেট।

ইয়ুথনেটের জাতীয় নেটওয়ার্ক সমন্বয়কারী জিমরান মো: সায়েক উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন করে জানিয়েছেন, বিপদাপন্ন মানুষের জন্য আর মানবিক সহায়তা দরকারা। ঘর পুড়িয়ে দেয়া মানুষেরা গৃহ নির্মাণের আকুতি জানিয়েছেন। তাই সবাইকে ম্রো সম্প্রায়ের পাশে থাকা উচিত।

২০২২ সালের ২৬ মার্চ লামা সরই ইউনিয়নে লাংকম ম্রো পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া ও রেংয়েন ম্রো পাড়া মিলে ৩৬টি পরিবারের বসবাস করা ৪০০ একর জায়গায় রাবার ও কাজু বাদাম চাষের লক্ষ্যে লামা রাবার কোম্পানি আগুন দেয়। আগুনে প্রায় ৩৫০ একর বনভূমি পুড়ে বিরান হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এরপর থেকেই ৪০০ একর জমি রক্ষায় আন্দোলন করে আসছে পাড়াবাসী। ওই ঘটনায় প্রথম থেকেই জায়গা দখলের অংশ হিসেবে রাবারবাগানের মালিক কামাল উদ্দিনের মদদে তাঁর লোকজন আগুন দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন ক্ষতিগ্রস্তরা। এ ঘটনায় পাড়াবাসী মামলা করলে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর মধ্যে রেংয়েন ম্রো পাড়ার একটি ঝিরিতে বিষ ঢালা ও ৩০০টি কলাগাছ কেটে ফেলার অভিযোগও ওঠে রাবার কোম্পানির লোকজনের বিরুদ্ধে।জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ নাগরিক তথ্যানুসন্ধানে এসব অভিযোগের সত্যতাও প্রমাণিত হয়েছে। ওই ঘটনার পর কয়েক দিন ধরে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটে পড়ে তিনপাড়ার ৩৬টি পরিবার। এদিকে খাদ্যসংকটে পড়া ৩৬ পরিবারকে ৮ মে লামা উপজেলা প্রশাসন ত্রাণ দিতে গেলে প্রতিবাদস্বরূপ তা ফিরিয়ে দেয় তারা। পরদিন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জহিরুল ইসলামের নেতৃত্বে জনপ্রতিনিধি ও ইউএনও ক্ষতিগ্রস্ত পাড়ায় গিয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে ত্রাণ নেয় তারা।

বান্দরবান জেলা পরিষদের পরিদর্শন কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, পাঁচ বছরের জন্য লিজ নেওয়া জমি প্রায় ২৫ বছর ধরে জোরপূর্বক ধরে রেখেছে কোম্পানিটি। বান্দরবান জেলা পরিষদের একটি তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পাঁচ বছরের মধ্যে রাবার বাগান সৃজন করার শর্তে লিজ নেয়া জমি ১৯৯৬ সালে দেয়া হয়। কিন্তু ২৫ বছর অতিবাহিত হলেও লিজ নেয়া জায়গার ওপর কোনো ধরনের রাবার রোপণ করা হয়নি। আইনগতভাবে লিজ নেয়া জায়গার ওপর লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কোনো ধরনের বৈধ অধিকার নেই। আইন অনুযায়ী এটি বাতিলযোগ্য এবং অতিসত্বর তা বাতিল করার সুপারিশ করছি।’ সব ধরনের শর্ত ভঙ্গ করে বেআইনিভাবে লিজের জমির বাইরে গিয়ে দখলদারি চালাতে ম্রো পাড়াবাসীকে উচ্ছেদ করার সব ধরনের চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি । অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রীতিমতো নীরবতা পালন করে যাচ্ছে।

ম্রো জাতিগোষ্ঠীর ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে ইয়ুথনেট নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান, এ হামলা সুস্পষ্ট মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ম্রো সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষার পাশাপাশি হামলার সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ম্রোদের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করতে হবেই।

আপনার মতামত লিখুন :