আগৈলঝাড়ায় মুজিব বর্ষ পালনের মতবিনিময় সভা

প্রকাশিত : ৬ মার্চ ২০২০
ptroz

অপূর্ব লাল সরকার, আগৈলঝাড়া (বরিশাল) থেকে : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী পালনকে সামনে রেখে বরিশালের আগৈলঝাড়ায় দেড়শ’ স্কুল, কলেজ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতিদের ডেকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মতবিনিময়ের ছদ্মাবরণে নিজের লেখা দেড়লাখ টাকার বই বাধ্যতামূলক বিক্রির অভিযোগ করেছেন একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ। গতকাল বিকেলে উপজেলার শহীদ সুকান্ত আবদুল্লাহ হলরুমে উপজেলা নির্বাহী অফিসার চৌধুরী রওশন ইসলামের সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতিদের সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশত বার্ষিকী পালন বিষয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত, সরকারী শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ সরদার আকবর আলী, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সুনীল কুমার বাড়ৈ ও সাধারণ সম্পাদক আবু সালেহ মো. লিটন, থানা অফিসার ইন চার্জ মো. আফজাল হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান মলিনা রানী রায়, মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার, শিক্ষা অফিসার মো. সিরাজুল হক তালুকদার, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. নজরুল ইসলাম, একাডেমিক সুপারভাইজার প্রাণকুমার ঘটকসহ বিভিন্ন দপ্তরের সরকারী কর্মকর্তা ও উপজেলার ১৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতিগণ। অনুষ্ঠিত সভা শেষে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করার পরে নিজের লেখা দু’টি বই ক্রয় করতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

সভা শেষে উপজেলার ৩৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২টি কলেজ, ৬টি স্কুল এন্ড কলেজ, ৬টি মাদ্রাসা, ১টি ভোকেশনাল স্কুল, ৯৭টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ মোট ১৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের উপজেলা নির্বাহী অফিসার চৌধুরী রওশন ইসলামের লেখা ‘প্রতিবিম্ব’ ও ‘দৈনন্দিন গল্প’ নামের ৫টি করে মোট ১০টি বই বাধ্যতামূলক কিনতে শিক্ষকদের বাধ্য করা হয়। ‘দৈনন্দিন গল্প’ বইটির গায়ে মূল্য লেখা রয়েছে ১৫০টাকা ও ‘প্রতিবিম্ব’ বইটির মূল্য লেখা রয়েছে ১৩০টাকা। সে হিসেবে ১০টি বইয়ের মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৪শ’ টাকা। তবে শিক্ষকদের কাছে বাধ্যতামুলক বিক্রি করা ১০টি বইয়ের মূল্য রাখা হয়েছে ১ হাজার টাকা। ১ হাজার টাকার বই বিক্রির হিসেবে ১৫০টি প্রতিষ্ঠান প্রধানদের দেড় লাখ টাকার বই কিনতে বাধ্য করেছেন ইউএনও।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বই কিনতে বাধ্য হওয়া একাধিক প্রধান শিক্ষক বলেন, তারা ১হাজার টাকা দিয়ে বই কেনার জন্য কেউ প্রস্তুতি নিয়ে সভায় আসেননি। ইউএনও’র নির্দেশনায় মানসম্মাণ আর চাকরির ভয়ে সহকর্মী, পরিচিতজনদের কাছ থেকে ধার দেনা করে তারা বই নিতে বাধ্য হয়েছেন। ওই দিন যারা নিতে পারেন নি তাদের পরবর্তীতে অবশ্যই বইগুলি নিতে হবে। জাতির পিতার শতবর্ষ উদযাপনের জন্য ডাকা সভায় ইউএনও’র নিজের লেখা বই কিনতেই হবে তা তারা জানতেন না।
শিক্ষকেরা অভিযোগে বলেন, ঘটনা করে শিক্ষকদের ডেকে ইউএনও নিজেকে কি প্রমাণ করতে চেয়েছেন তা শিক্ষকদের বোধগম্য নয়। স্ব-স্ব শিক্ষা বিভাগের মাধ্যমেও মুজিব বর্ষ পালনের নির্দেশনা দেয়া যেত বলেও মন্তব্য করেন তারা।

তারা অভিযোগে আরও বলেন, উচ্চাদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারী সকল অফিস ও অডিটরিয়ামে জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি টাঙ্গানো বাধ্যতামূলক। স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দাবির মুল্যায়ণ করে মন্ত্রী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপি’র প্রচেষ্টায় আগৈলঝাড়ায় কোটি টাকা ব্যয়ে ‘শহীদ সুকান্ত আবদুল্লাহ অডিটোরিয়াম’ নির্মিত হবার পরে সেই অডিটোরিয়ামে বছর ঘুরলেও সেখানে এখনো ঠাঁই হয়নি জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর কোন ছবি। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে জাতির পিতার সাথে শহীদ হওয়া মন্ত্রীপুত্র সুকান্ত আবদুল্লাহর নামে অডিটেরিয়ামের নামকরণ হলেও সেখানে ঠাঁই মেলেনি শহীদ সুকান্ত আবদুল্লাহর কোন ছবি! মূলত: বই মেলা আর মুজিব বর্ষ পালনের ছদ্মাবরণে ইউএনও’র লেখা বই বাধ্যতামূলক বিক্রিই ছিল মতবিনিময় সভা ডাকার মূখ্য উদ্দেশ্য। অডিটোরিয়ামে জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি না থাকায় শিক্ষকদের সাথে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতা স্বপক্ষের সাধারণ জনসাধারণও। ইউএনও চৌধুরী রওশন ইসলামের পূর্বের কর্মস্থল চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা অডিটোরিয়ামেও জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি রাখা তিনি আবশ্যক মনে করেননি। যার স্বপক্ষে বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, ইউএনও চৌধুরী রওশন ইসলামের লেখা একটি বই একুশের জাতীয় বই মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হয়। ওই বই বিক্রির জন্য ইউএনও উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিকে কৌশলে ম্যানেজ করে বই বিক্রির জন্য আগৈলঝাড়ায় এবছর সরকারী খরচে বইমেলার আয়োজন করেন। প্রথমে একদিনের জন্য বইমেলা অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও ইউএনও’র লেখা বই আশাতীত বিক্রি না হওয়ায় সরকারী খরচে নিজের লেখা বই বিক্রির জন্য বর্ধিত করে বইমেলা তিনদিন করা হয়। নাম না প্রকাশের শর্তে উপজেলার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসনের প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয় ১২ ফ্রেব্রæয়ারি। ওই প্রস্তুতি সভায় আগৈলঝাড়ায় বইমেলা সম্পর্কে ইউএনও কোন কথাই উত্থাপন করেননি। কৌশলী ইউএনও ১৬ ফেব্রæয়ারী রাতে স্থানীয় এমপি’র বাসভবনে সরকারী উন্নয়ন কাজের জন্য তার সাথে দেখা করতে গিয়ে আকস্মিকভাবে এমপি’কে বলে কৌশলে বইমেলা করার অনুমতি নিয়ে নেন। নিজের লেখা বই বিক্রির জন্য ঘটা করে সরকারী খরচে আয়োজন করেন বইমেলার।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার চৌধুরী রওশন ইসলাম শিক্ষকদের কাছে বাধ্যতামূলক বই বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি শিক্ষকদের বলেছেন তার লেখা বই যদি কেউ কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন তবে তারা নিতে পারেন। তিনি আরও বলেন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সম্পাদকেরা তার লেখা ৬-৭শ’ বই চেয়ে নিয়েছেন বিক্রি করে দেয়ার জন্য। তাদের বই দেয়ার জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসে বই সরবরাহ করা হয়েছে। যদি কোন শিক্ষককে বই কিনতে বাধ্য করা হয় সেটা করেছেন শিক্ষক সমিতির নেতারা। অডিটোরিয়ামে জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি না রাখার ব্যাপারে তিনি বলেন, ছবি না টানানোর কারণে উচ্চাদালতের নির্দেশ অমান্য করা হয়নি। অডিটোরিয়ামে ছবি না থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি টানানোর বিষয়ে তিনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

শিক্ষক সমিতির সভাপতির উপর ইউএনর’র বাধ্যতামূলক বই বিক্রির দায় চাপানোর বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক সমিতির সভাপতি সুনীল কুমার বাড়ৈ বলেন, ইউএনও তার লেখা বই যাদের পছন্দ হয় তাদের সংগ্রহ করতে বলেছিলেন। তার কথানুযায়ী শিক্ষকদের বই সংগ্রহ করতে বলা হয়েছিল। মাধ্যমিক স্তরের কোন শিক্ষককে বই কিনতে বাধ্য করা হয়নি। প্রাথমিক স্তরে কি হয়েছে তা তিনি জানেন না জানিয়ে অডিটোরিয়ামে জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি না থাকার বিষয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

আপনার মতামত লিখুন :