আগৈলঝাড়ায় ৫২৮ বছরের প্রাচীণ ঐতিহ্যবাহী মনসা মন্দিরে ১৭ আগস্ট বার্ষিক পূজা

প্রকাশিত : ১০ আগস্ট ২০২২

অপূর্ব লাল সরকার, আগৈলঝাড়া (বরিশাল) থেকে: মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের অমর কাব্য “মনসা মঙ্গল” রচয়িতা প্রখ্যাত কবি বিজয় গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক মনসা মন্দিরে পুজা পূর্ববর্তী তিনদিন ব্যপী রয়ানী গান শুরু হবে ১১ আগস্ট। চলবে ১৩ আগস্ট গভীর রাত পর্যন্ত। রয়ানী গান পরিবেশন করবে বরিশালের ঐতিহাসিক রয়ানী দল শ্রীশ্রী মা মনসা সম্প্রদায়ের শিল্পীরা। রয়ানী শেষে ১৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে মনসা দেবীর বার্ষিক পূজা।

বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ অমর কাব্যগ্রন্থ পদ্মপুরাণ বা মনসা মঙ্গল কাব্য রচয়িতা বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামে জন্ম নেয়া বিশ^খ্যাত মধ্যযুগীয় অমর কবি বিজয় গুপ্ত ৫২৮ বছরের প্রাচীণ মনসা মন্দিরে দেবী মনসার বার্ষিক পূজা ১৭ আগস্ট বুধবার। প্রতিবছর মহা আড়ম্বড়ের মধ্য দিয়ে বাংলা শ্রাবণ মাসের শেষদিনে ‘বিষহরি’ বা মনসা দেবীর পূজা ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

পূজার আগে ওই মন্দিরে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ছন্দ, পয়ার আর সুরের মূর্ছণায় দেবীর আহুতি পর্ব রয়ানী গান উৎসব। রয়ানী গান মূলত: মনসা মঙ্গল কাব্য থেকে নেয়া ছন্দ আর সুরের অনন্য পরিবেশনা। এই রয়ানী গানে চাঁদ সওদাগর, তার পুত্র লক্ষিন্দর আর পুত্রবধূ সতী বেহুলার অপার সংগ্রামী জীবনের মাধ্যমে সর্প দংশণে মৃত স্বামী লক্ষিন্দরকে পুনরায় বাঁচিয়ে তোলার মাধ্যমে মর্ত্যলোকে দেবী হিসেবে ‘মনসা’ পূজিত হওয়ার কাহিনীর বর্ণনা। শিল্পীদের রং, ঢং, পয়ার, আর সুরের মূর্ছনার শৈল্পিক বর্ণনার অপরূপ নিদর্শণ।

“ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”-এ বাক্যকে ধারণ করে বিজয় গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত মনসা মন্দিরে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে বার্ষিক পূজার দিন দেশ-বিদেশ ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার ভক্ত ও পূণ্যার্থীর মা মনসার চরণে তাদের পূষ্পার্ঘ্য নিবেদনের জন্য মন্দিরে সমবেত হন।

মনসা মঙ্গল কাব্য, ইতিহাস ও জনশ্রæতি মতে, আজ থেকে ৫২৮ বছর আগে মধ্যযুগে সুলতান হোসেন শাহ্র রাজত্ব আমলে ইংরেজী ১৪৯৪ সনে কবি বিজয় গুপ্ত সর্পের দেবী মনসা বা বিষহরি দেবী কর্র্তৃক স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে নিজ বাড়ির সুবিশাল দীঘি থেকে পূজার একটি ঘট তুলে গৈলা গ্রামের নিজ বাড়িতে দেবী মনসার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরে দেবী মনসার স্বপ্নাদেশে দীঘির ঘাটের পার্শ্ববর্তী একটি বকুল গাছের নীচে বসে “পদ্মপুরাণ” বা “মনসা মঙ্গল” কাব্য রচনা করেন।

বাংলা সাহিত্যের তৎকালীন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক সুলতান হোসেন শাহ্র রাজত্বকালে ওই বছরই বিজয় গুপ্ত মনসা মঙ্গল রচনার জন্য রাজ দরবারে “মহাকবি” খেতাবে অতিষ্ঠিত হন।

জনশ্রæতি রয়েছে, দেবী পদ্মা বা মনসা বিজয় গুপ্তের কাব্য রচনায় সন্তুষ্ট হয়ে আশির্বাদ হিসেবে বিজয় গুপ্তকে স্বপ্নে বলেছিলেন “তুই নাম চাস, না কাম চাস?” উত্তরে বিজয় গুপ্ত বলেছিলেন “আমি নাম চাই”। যে কারণে তার নাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরওে তিনি দেহত্যাগ করেন উত্তরাধিকার বিহীন। ঐতিহাসিকভাবে বিজয় গুপ্তর সঠিক জন্ম বা মৃত্যুর তারিখ জানা যায়নি। তবে গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সম্ভবত ৭০ বছর বয়সে ১৫২০ খ্রিষ্টাব্দে কাশীধামে তিনি দেহত্যাগ করেন। সেই হিসেবে তার জন্ম ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে। ৪৪ বছর বয়সে তিনি মনসা মঙ্গল কাব্য রচনা করেন। মহাকবি বিজয় গুপ্তের পিতার নাম সনাতন গুপ্ত ও মাতার নাম রু´িনী দেবী। বিজয় গুপ্তের আগেও একাধিক পন্ডিত ও কবি মনসা মঙ্গল রচনা করেছিলেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন ময়মনসিংহ’র কানাহরি দত্ত।

তবে তারা কেউ তাদের কাব্যে দিন, তারিখ ও সন লিপিবদ্ধ করেননি। বিজয় গুপ্তই সর্বপ্রথম তাঁর রচিত মনসা মঙ্গল কাব্যে ইংরেজী তারিখ ও সন লিপিবদ্ধ করেন। অন্যান্যদের তুলনায় বিজয় গুপ্তর কাব্য নিরস হলেও নৃপতি তিলক খ্যাত সুলতান হোসেন শাহ’র গুণকীর্তন ও ইংরেজী তারিখ ও সন লিপিবদ্ধ করায় তিনিই হয়ে ওঠেন মনসা মঙ্গল কাব্য রচয়িতাদের মধ্যে অন্যতম। আর এ কারণে রাজদরবারে “মহাকবি” খেতাব পাওয়ার পর ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মহাধুমধামের সাথে মনসা দেবীর পূজার প্রচলন ঘটে। যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। কবি বিজয় গুপ্ত স্মৃতি রক্ষা মনসা মন্দির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কমিটির উপদেষ্টা একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও কলামিস্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা অজয় দাশগুপ্ত জানান, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানী বর্বর সেনারা মন্দির থেকে মনসা দেবীর পাথরের বিগ্রহ চুরি করে নিয়ে যায়। স্বাদীনতা উত্তর সময়ে প্রতিষ্ঠিত ঘট ও নির্মিত প্রতিমায় পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় দেশ বিদেশের ভক্তবৃন্দের অনুদানে ২০০৮ সালে প্রায় ১ মে.টন ওজনের পিতলের তৈরি মনসা দেবীর প্রতিমা পুন:স্থাপিত হয়।

বর্তমানে মন্দিরটি ধর্মীয় উপাসনালয়ের পাশাপাশি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও সর্বত্র ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। বরিশাল জেলা প্রশাসনের দর্শনীয় স্থানের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ঐতিহাসিক বিজয় গুপ্তের মনসা মন্দিরের নাম। বিচারপতি, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব, বিদেশী কুটনৈতিকগণ, বিভিন্ন দুতাবাসের কর্মকর্তাসহ দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা দর্শনে আসেন দেখতে আসেন ঐতিহাসিক মনসা মন্দির। দেশ-বিদেশের পুণ্যার্থী, দর্শক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের পদচপরণায় মুখরিত পর্যটনের উল্লে¬খযোগ্য স্থান হিসেবে রয়েছে এ মন্দিরের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি।

 

আপনার মতামত লিখুন :