শ্বাসকষ্ট আক্রান্ত ব্যক্তি মারা গেলে লাশ নামাতে দিলো না স্বজনরা!

প্রকাশিত : ৬ মে ২০২০

মানুষ মারা গেলে তার আপনজনেরা ছুট আসবে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু করোনা সংক্রমণের ভয়ে মানুষের চেতনা এখন আর স্বাভাবিক নেই। বরং অমানবিক, কিছুটা হিংস্রও হয়ে গেছে। ময়মনসিংহের গৌরিপুরের ঘটনা। আব্দুল হাই (৬৫) বার্ধক‌্যজনিত নানা সমস‌্যায় ভুগছিলেন। শ্বাসকষ্ট ছিল। করোনার মধ‌্যে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হয়নি। ছেলে শাহজাহান বাবা-মাকে নিয়ে থাকতেন ভালুকায়। সোমবার (৪ মে) সকালে তারা নিজ এলাকা গৌরিপুরের সাতুতি গ্রামে ফেরেন। কিছুক্ষণের মধ‌্যে আব্দুল হাইয়ের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। সম‌স‌্যা বাড়তে থাকে। ছেলে শাহজাহান ও স্ত্রী ফিরুজা খাতুন তাকে নিয়ে ছোটেন ময়মনসিংহ মেডিক‌্যালে।

দিন শেষ হয় ডাক্তার দেখিয়ে আর নানা ধরনের টেস্ট করিয়ে। রাত হয়ে যায়। একটি অ‌্যাম্বুলেন্সে করে অসুস্থ আব্দুল হাইকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হন স্ত্রী ও ছেলে। পথে রাত ৯টার দিকে মারা যান আব্দুল হাই। সারাদিনের ধকল শেষে আশার আলো নয়, একরাশ অন্ধকারে ছেয়ে যায় স্ত্রী-সন্তানের মন। বাবার লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরেন শাহজাহান। তখনো তিনি জানতেন না আপন আত্মীয়রা কতটুকু নির্দয় হতে পারেন।

লাশবাহী অ‌্যাম্বুলেন্স আব্দুল হাইয়ের বাড়িতে ঢোকার পর স্বজনরাসহ আশপাশের কিছু প্রতিবেশি এগিয়ে আসেন। শাহজাহান ভেবেছিলেন তাকে সাহায‌্য করতে এগিয়ে এসেছে হয়তো। কিন্তু তার অবচেতন মনকে দারুন এক ঝটকা দিয়ে বাস্তবতা অন‌্য দিকে মোড় নিলো। সবাই একবাক‌্যে বলতে লাগলো- আব্দুল হাই করোনায় মারা গেছে। তার লাশ নামানো যাবে না। দাফন তো এ গ্রামে হবেই না। শাহজাহান আর ফিরুজা খাতুনের কোনো কথাই তারা কানে তুললেন না। স্বজন হারানোর ব‌্যাথার সাথে স্বজনদের মারমুখি আচরণে হতবাক তারা।

হাজার অনুরোধ উপরোধেও কাজ হলো না। চোখের পানি তাদের হৃদয়কে গলাতে পারলো না। এক পর্যায়ে শাহজাহানকে মারধর করে বাড়ি থেকে তাদেরকে বের করে দিলেন তারা। উপায়ন্তর না পেয়ে বাবার লাশ নিয়ে ফিরে চললেন শাহজাহান।তাঁতকুড়া এলকায় গিয়ে অ‌্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দিতে হলো। পরে একটি ভ‌্যান যোগাড় করে তাতে বাবার লাশ নিয়ে শাহজাহান গেলেন কোনাপাড়ায় এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে। আগে থেকে করোনায় মৃতের গুজব ছড়িয়ে পড়ায় সেখানেও বাবার লাশ দাফন করতে পারলেন না শাহজাহান। ভাঙ্গা হৃদয় আরো ভেঙ্গে গেলো।

মানুষের বিবেক কী মরেই গেছে? কোথাও কী মানবতা নেই? তখন হয়েতো শাহজাহান এ কথাগুলোই ভাবছিলেন। হয়তো আরো তোলপাড় চলছিল তার অন্তরে। বাবার লাশ ভ‌্যানে নিয়ে বেড়াতে লাগলেন শাহজাহান। ভ‌্যানে স্বামীর লাশের পাশে বসে কেঁদে বুক ভাসিয়ে চলেছেন ফিরোজা খাতুন। আত্মীয়-স্বজনদের কাছে প্রত‌্যাখ‌্যাত হয়ে, নানা গ্রাম ঘুরে বাবার মরদেহ নিয়ে ভ্যানটি পৌরসদরের একটি ধান মহালের সামনে থামায় শাহজাহান। রাত ততক্ষণে অনেক গভীর। এক সময় এ খবর পৌঁছায় থানায়। পুলিশ জনগণের বন্ধু- যেন এ কথা সত‌্যতা জানাতে ছুটে আসেন তারা।

মঙ্গলবার (৫ মে) সকাল সাড়ে ৯টায় পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন ও ‘এসো গৌরীপুর গড়ি’ নামের একটি সামাজিক সংগঠনের সহায়তায় আপন ঠিকানা খুঁজে পায় আব্দুল হাইয়ের মরদেহ। নিজ বাড়িতে জানাজা শেষে পৌরসভার পশ্চিম দাপুনিয়ার গোরস্থানে দাফন করা হয় তাকে। আব্দুল হাইয়ের ছেলে শাহজাহান জানান, ভালুকা উপজেলার স্কয়ার মাস্টারবাড়ি এলাকায় তার বাবা আবদুল হাইকে সঙ্গে নিয়ে কর্মস্থলে থাকতেন। দীর্ঘদিন ধরে বাবা শ্বাসকষ্ট রোগে ভুগছিলেন। সোমবার সকালে বাবাকে নিয়ে শাহজাহান গৌরীপুর উপজেলার সাতুতী গ্রামে তার নিজ বাড়িতে ফেরেন। এরপরে এ ঘটনাগুলো ঘটে।

মৃত আবদুল হাইয়ের স্ত্রী ফিরুজা খাতুন বলেন, ‘জমিসংক্রান্ত বিরোধ থাকার কারণে মরদেহ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামাতে চাইলে রিপন, সাইফুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম, ফারুক মিয়া, রফিক মিয়া আমার ছেলেকে মারধর করে। সবাইকে তারা বলেছে এ করোনায় মারা গেছে। তাই এখানে লাশ দাফন করা যাবে না। গৌরীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বোরহান উদ্দিন জানান, মৃত আবদুল হাইয়ের সঙ্গে তার স্বজনদের পারিবারিক ও জমিসংক্রান্ত বিরোধ ছিল। এজন্য তারা করোনার ভয় দেখিয়ে দাফন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নিয়ে আলোচনা করে সমস্যা সমাধান করা হয়েছে এবং লাশ দাফনের ব্যবস্থা কর হয়েছে।

 

আপনার মতামত লিখুন :